• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

বাস্তবতার নিরিখে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন

   ২২ জুন ২০২৫, ০৭:৫২ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

মাহবুব নাহিদ

নির্বাচন পদ্ধতি একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত নির্মাণের অন্যতম প্রধান উপাদান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা’ (Proportional Representation - PR) নিয়ে আলোচনা বাড়ছে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, অধিকার পরিষদসহ কিছু ছোট দল এই পদ্ধতির পক্ষে কথা বলছে। যদিও এ পদ্ধতি শুনতে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মনে হয়, বাস্তবতা হলো—এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে, দুর্বল সরকার ও স্বৈরশাসনের ঝুঁকি বাড়বে, এবং আমাদের ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। নিচে এ ব্যবস্থার বিপজ্জনক দিকগুলো বিশ্লেষণ করা হলো—

১. পদ্ধতিগত জটিলতা ও সাধারণ ভোটারের দুর্বধ্যতা:

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি বিশেষ করে ‘তালিকা ভিত্তিক PR’ (List-based PR) সাধারণ ভোটারের জন্য বেশ জটিল। এখানে সরাসরি প্রার্থী নির্বাচন নয়, বরং দলকে ভোট দিতে হয় এবং দল তার তালিকা থেকে সংসদ সদস্য নির্ধারণ করে। এতে সাধারণ মানুষ তাদের ভোটে কাকে সংসদে পাঠাচ্ছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে না। এই পদ্ধতিতে গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান সরাসরি প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি ক্ষুণ্ন হয়।

২. দুর্বল ও অস্থির সরকার গঠনের আশঙ্কা:

PR পদ্ধতিতে সাধারণত কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। ফলে জোট সরকার গঠনের প্রয়োজন হয়, যার ফলে নীতিগত অস্থিরতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং ক্রমাগত রাজনৈতিক দরকষাকষি শুরু হয়। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর রাষ্ট্রে এটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। আমাদের প্রতিবেশী আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলো এই ধরনের দুর্বল সরকারকে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

৩. প্রার্থী নয়, দলে গুরুত্ব বেশি—জনগণের প্রতিনিধিত্ব কম:

PR ব্যবস্থায় ভোটার সরাসরি কোনো প্রার্থীকে ভোট দেয় না—দলকে দেয়। ফলে ব্যক্তির জনপ্রিয়তা, দায়বদ্ধতা বা নির্বাচনী এলাকার প্রতি দায়বোধের কোনো গুরুত্ব থাকে না। এতে করে জনপ্রতিনিধিদের স্থানীয় উন্নয়ন বা জনসম্পৃক্ততা হ্রাস পাবে। এই ব্যবস্থায় একজন সংসদ সদস্য তার এলাকার মানুষের নয়, দলীয় নেতৃত্বের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। যার ফলে আমরা যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি তা একদম পূর্ণতা পাবে না।

৪. চরমপন্থি ও নিষিদ্ধ দলগুলোর প্রবেশাধিকার:

PR পদ্ধতিতে কম সংখ্যক ভোট পেলেও কোনো দল সংসদে আসন পেতে পারে। এই ব্যবস্থার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো—এতে চরমপন্থি ও রাষ্ট্রবিরোধী আদর্শধারী দলগুলোর সংসদে প্রবেশ সহজ হয়ে যায়। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোও অন্য কোনো ছোট দলের ছত্রছায়ায় তাদের ভোটব্যাংক কাজে লাগিয়ে সংসদে প্রতিনিধি পাঠাতে পারে। এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক ভয়ংকর হুমকি।

৫. স্থানীয় সমস্যা উপেক্ষিত হয়, কারণ নির্দিষ্ট এলাকার এমপি থাকে না:

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে এলাকার প্রতিনিধিত্ব উঠে যায়। সংসদ সদস্যদের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা থাকে না। ফলে জনগণের জল, রাস্তা, স্কুল, কৃষি, স্থানীয় দুর্নীতি, উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি ইস্যুগুলো আর সরাসরি সংসদে স্থান পায় না। এতে দেশের রাজনীতি হয়ে পড়ে কেন্দ্রভিত্তিক ও দলনির্ভর, যেখানে জনগণের বাস্তব অভাব-অভিযোগ উপেক্ষিত হয়।

৬. দলীয় নেতৃত্বের চরম কর্তৃত্ব—স্বৈরশাসনের সম্ভাবনা:

PR পদ্ধতিতে সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন তালিকা নির্ধারণ করে দলীয় নেতৃত্ব। ফলে দলপ্রধান বা কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে পুরো সংসদ গঠনের ক্ষমতা চলে যায়। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা নয়, বরং কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যে স্বৈরতান্ত্রিক একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অভিযোগ রয়েছে, PR পদ্ধতিতে সেটি আরও জাঁকিয়ে বসবে।

৭. নির্বাচনী জালিয়াতির নতুন রূপ: ভিন্ন ক্যালকুলেশনের ফাঁদ:

PR ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি ভোটের প্রভাব সমগ্র জাতীয় ফলাফলের ওপর পড়ে। ফলে একেকটি দল যদি প্রতিটি আসনে মাত্র ২০-৩০ হাজার করে ভোট পায়, তাদের সর্বমোট ভোটের ভিত্তিতে ২০–৩০টি আসন পর্যন্ত পেয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ কোনো দলের প্রতিটি আসনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও তারা ব্যাপক আসন পেয়ে যাবে—যা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অসংগতি।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পরিবর্তে দরকার বর্তমান প্রত্যক্ষ জনপ্রতিনিধিত্বভিত্তিক (first-past-the-post) নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। তার মানে, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এবং প্রশাসনকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পেশাদার ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচনে প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার, সেনা মোতায়েন, পর্যবেক্ষকদের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, বর্তমান সংকট, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের আলোকেই বলা যায়—সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। এটি দুর্বল সরকার, চরমপন্থার উত্থান এবং দলীয় স্বৈরতন্ত্রকে উসকে দেবে। তাই নির্বাচনী সংস্কারের অর্থ হওয়া উচিত—নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ, এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা, তা যে পদ্ধতিই হোক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ভিওডি বাংলা/ডিআর

[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়] 

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সুরাজনীতি এমন এক নদী যা শান্তির সাগরে মিশবেই
সুরাজনীতি এমন এক নদী যা শান্তির সাগরে মিশবেই
গণতন্ত্রকামী ভোটারদের অপমান করলেন ড. ইউনূস
গণতন্ত্রকামী ভোটারদের অপমান করলেন ড. ইউনূস
উৎসবের আনন্দ হোক নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ
উৎসবের আনন্দ হোক নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ