• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

একটি নাগরিক অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল- মাহফুজ আলম

   ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৬:০৫ পি.এম.
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। ছবি-সংগৃহীত

ভিওডি বাংলা ডেস্ক
জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন আন্দোলনকে বেগবান করতে সামনে থেকে সমন্বয়ের পাশাপাশি আড়ালে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মাহফুজ আলম তাদের একজন। আওয়ামী সরকারের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও গণ গ্রেপ্তারের মধ্যেও আন্দোলনটিকে সচল রাখার কাজ করেছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়নের পাশাপাশি সিনেমা ও সাহিত্য নিয়ে একাধিক কাজ করেছেন তিনি।

নিয়মিত পাঠচক্র করার পাশাপাশি অনিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশের সাথেও জড়িত থেকেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির একজন ছিলেন মাহফুজ আলম। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন মাহফুজ আলম।

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, ছাত্র-জনতার আকাঙ্খার সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠন নিয়ে বাসসের বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন মাহফুজ আলম।

প্রশ্ন : আপনার কাছে কোন কোন ঘটনাগুলো জুলাই অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিল?

মাহফুজ আলম : আওয়ামী লীগ মূলত শাপলা-শাহবাগের বাইনারি দিয়ে এমন একটা রাষ্ট্রীয় বিভাজন সামনে এনেছিল, যেখানে রাষ্ট্রকে হয় ইসলামিস্ট না হয় সেক্যুলার করার একটা দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। এসব বিভাজনের আড়ালে মূলত ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন আর আওয়ামী সরকারের দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে ‘বিরোধী দলের অস্তিত্বহীন’ একটা স্টাইলে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এসব কিছুর প্রতিক্রিয়াই ছিল ভ্যাট আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। তারপর ডাকসু নির্বাচন। আমরা যদি ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই তিনটা বিগ ইভেন্ট হিসেবে ধরি, তাহলে ১৮ সালের রাতের নির্বাচনের পর ধীরে সুস্থে একটা ঘটনা ঘটছিল। সেটা হলো, মুজিববাদী সংগঠনগুলোর বাইরে তরুণদের একটা ডেমোক্র্যাটিক প্রেসার গ্রুপের আবির্ভাব। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে থাকলেও তারা কিন্তু আসলে একটা পলিটিক্যাল ফ্রন্টই ছিল, যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। যেহেতু ১৮ সালের আন্দোলনে অংশ নেয়া কলেজে পড়–য়া ছেলেমেয়েরাই চব্বিশের অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল, তাই তাদের কাছে গত কয়েক বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের সিনারিওটা চোখের সামনে পরিষ্কার দৃশ্যমান ছিল। ফলত এই আন্দোলনে রাজনৈতিক সচেতনভাবে তাদের অংশ নেয়াটা সহজ ছিল।

এর বাইরে ছিল সীমান্ত হত্যাবিরোধী আন্দোলন। অন্য দিকে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ১৩ সাল থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত ছিল শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলার কালচার। আবরার ফাহাদের শহীদ হওয়ার ঘটনাটা আমাদের ভেতর বড় একটা সংবেদনশীলতা তৈরি করেছিল। এক দিকে আওয়ামী লীগের এমন দানব হয়ে ওঠা, আরেকদিকে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ তৈরিকৃত বয়ানগুলোকে ধরে ধরে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা, সব মিলিয়েই একটি নাগরিক অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

প্রশ্ন : জুলাই অভ্যুত্থানে কিভাবে একদমই ভিন্ন আদর্শের মানুষেরা এক হয়ে গিয়েছিল?

মাহফুজ আলম : আমরা সাত-আট বছর ধরে ক্যাম্পাসে এক্টিভিজম করার কারণে কম্প্রোমাইজিং বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা জানতাম। আর প্রত্যেকটা জায়গাতেই কিছু কম্প্রোমাইজিং এক্টর থাকে, আমরা তাদের চিনতাম। তাই এবার শুরুতেই আমরা বিষয়টা নিয়ে কনসার্ন ছিলাম এবং যেসব জায়গায় মতানৈক্য থাকতে পারে তা আমরা আগেই ডিল করে ফেলেছিলাম।

প্রশ্ন : সাংস্কৃতিক বোঝাপড়াটা এই অভ্যুত্থানে কেমন প্রভাব ফেলেছিল?

মাহফুজ আলম : এমন একটা গ্রুপের দরকার ছিল, যারা সরাসরি ইসলামিস্টও না, আবার যারা ইসলামোফোবিকও না। মধ্যপন্থাটা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম মাদরাসার ছেলেপেলেদের মধ্যে, কলেজ-ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মধ্যে, এমনকি গ্রাম ও শহুরে জীবনযাপন করা মানুষের মধ্যে। আর এর মাধ্যমেই বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের একটা ঐক্য ঘটেছিল। কাজ পেছনে হতো, কিছু এক্টিভিটি সামনে হতো। কখনো আখতার (এনসিপির সদস্য সচিব) সামনে থাকত, কখনো আকরাম (এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব), অথবা কখনো সামনে থাকত নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি। নাহিদ আমাদের সাথে যুক্ত ছিল, নিয়মিত বইটই পড়ত কিন্তু সে সময় পলিটিক্যালি এতটা মুভ করেনি। আসিফ (স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা) পলিটিক্যাল এক্টিভিজম করত। শোয়েব আবদুল্লাহ চলে গেল গবেষণায়। নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী সে সময় এবি পার্টিতে জয়েনও করেছিল। এই যে এক্টরগুলো, তারা কিন্তু ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন উপায়ে আসলে একই কাজ করছিল, একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক মধ্যপন্থার উপায় খুঁজছিল।

প্রশ্ন : তাহলে আন্দোলনে নাহিদ ইসলাম কিভাবে সামনে এলেন?

মাহফুজ আলম : নাহিদ ইসলাম পলিটিক্যালি তখন ফ্রেশ একটা ক্যারেক্টার ছিল। সে যেহেতু শহুরে স্কুলে পড়ুয়া একজন, তাই মধ্যবিত্ত সমাজের তরুণদের সাথে তার বোঝাপড়াটা অন্যদের তুলনায় সহজে হতো। কাজগুলোকে আপনি অনেকটা ডিভিশন প্লে বলতে পারেন। আমাদের স্বপ্নটা যেন বেঁচে থাকে, এটাই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। কে সামনে গেল, কে পেছনে থাকল- সেটা একদমই ম্যাটার করত না।

প্রশ্ন : জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িতদের ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া কার্যকরী বলে কি আপনি মনে করেন?

মাহফুজ আলম : ট্রুথ আসলে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং বিষয়। কিছুদিন আগে স্বৈরাচারী আমলের নির্বাচন কমিশনার আদালতের কাছে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের আমলে ভুয়া জাতীয় নির্বাচন হতো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সেগুলো ছিল না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা একজন এই কথা বলার মাধ্যমে ‘ট্রুথ’ সামনে আনছে। এই কথাগুলোর স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ থেকে আসতে হবে। কারণ বিচারিক প্রক্রিয়া ভিন্ন জিনিস, আর কোশ্চেন অব মোরালিটির জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের এই হত্যাকাণ্ড স্বীকার করেই সামনে আসতে হবে।

একজন শিক্ষক, সে গণহত্যায় অংশ নেয়নি। কিন্তু সে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। এই শিক্ষককে তো আপনি গণহত্যার শাস্তি দিতে পারবেন না। বরং তার পাপকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমা চেয়ে সামনে এগোতে হবে। পুলিশ তো সরাসরি জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িত। একজন দু’জন নয়; বরং পুলিশের পুরো ইনস্টিটিউশন জড়িত। র‌্যাব গুম ও ক্রসফায়ারের সাথে জড়িত। কিন্তু পুলিশ ও র‌্যাব উভয়ই ইনস্টিটিউশন হিসেবে ক্ষমা চেয়েছে এবং নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে তারা একটা রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার ধারণা এই পদ্ধতির মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্র হিসেবে আরো শক্তিশালী হবো।

প্রশ্ন : কিন্তু জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে তো জনমনে অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে...?

মাহফুজ আলম : আমাদের একটা স্পিড ট্রায়াল দরকার ছিল। যেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় খুন, গুম ও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের সাজা দেয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, বিচারব্যবস্থাও স্বৈরাচারী আমলে ভেঙে দেয়া হয়েছে। যেসব বিষয়ের উপর বিচার ও তদন্ত দাঁড়িয়ে আছে, সেই ইনস্টিটিউশনগুলোকেও নষ্ট করা হয়েছে। তাই যখন বিচার শুরু হলো, তখন প্রত্যাশার চাইতেও ধীরগতির হয়েছে। এসব সঙ্কট পেরিয়ে দু’টো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। শুধু সরকার না; আমার ধারণা নাগরিকরাও বিচার প্রক্রিয়া সহজ করতে হেল্প করছে। আশা করি দ্রুতই জুলাইয়ে শহীদ হওয়া পরিবার ও দেশবাসী দৃশ্যমান বিচার দেখতে পাবে।

প্রশ্ন : গণ-অভ্যুত্থানের এক দফা দাবি ঘোষণার সময় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে আকাঙ্খা, তার দিকে কি এগোতে পেরেছি?

মাহফুজ আলম : সত্যি বলতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তখনই সম্ভব যখন বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চার সংস্কার হবে। এখন আপনি আগের মতো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে তো আর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আনতে পারবেন না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সুযোগটা নেন নাই। এখন আপনি যদি বিরোধী দল বা পক্ষকে সম্মান না জানান, তাদেরকে একটা শক্ত অবস্থানে আসতে না দেন, তাহলে রাষ্ট্র কি সঠিকভাবে দাঁড়ায়? বেগম খালেদা জিয়াকে হাসিনা ভয়াবহ রকমের আক্রমণ করেছে, কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছে। কিন্তু ওই অর্থে বেগম খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন নাই। সমস্যা হলো, এই কালচারটা বাংলাদেশের পলিটিক্সে তৈরি হয় নাই। এখনো কোনো দলই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে স্পেস দিতে চান না। তাহলে তো আর রাজনৈতিক সংস্কার হলো না। গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার বাইরে নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

ভিওডি বাংলা/ এমপি

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
আ’লীগকে ফেলে দেওয়ার জন্য সব করেছি: সিবগাতুল্লাহ
আ’লীগকে ফেলে দেওয়ার জন্য সব করেছি: সিবগাতুল্লাহ
মুক্তিকামী সব রাজনৈতিক শক্তি ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার : নাছির
মুক্তিকামী সব রাজনৈতিক শক্তি ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার : নাছির
আ.লীগ ভোটে থাকবে কি না সিদ্ধান্ত ইসির: ড. ইউনূস
আ.লীগ ভোটে থাকবে কি না সিদ্ধান্ত ইসির: ড. ইউনূস