কোটি টাকার বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের
বরগুনায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখলের মহোৎসব


বরগুনা ও পটুয়াখালী বনাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় প্রতিদিন সংরক্ষিত বনভূমির শত শত গাছ পালা কেটে জমি দখলের মহোৎসব চলছে। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশেই চলছে অবৈধ সব করাতকল। গড়ে উঠছে শত শত ঘরবাড়ি। সহস্রাধিক গাছ কেটে ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে বনের ভেতর দিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রশস্ত মাটির রাস্তা। গহীণ বনের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে মাছের ঘের, কৃষি প্রকল্প, গবাদিপশুর খামার। চলছে মাদক কারবার। আর এর সবই হচ্ছে বনবিভাগকে ম্যানেজ করে।
নদী ও সাগর তীরবর্তী বনাঞ্চলের হাজার হাজার গাছ কেটে অবৈধভাবে সাগরের বিস্তির্ণ এলাকা দখল করে চলছে খুটাজাল বাণিজ্য। আর এসব বাণিজ্যের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে খোদ বিভাগীয় বন সংরক্ষক মোঃ সফিকুল ইসলাম, সহকারী বন সংরক্ষক এবং বরগুনা অঞ্চলের রেঞ্জার আখতারুজ্জামানেরn বিরুদ্ধে। সরেজমিন পরিদর্শনে বনবিভাগের এমন নজিরবিহীন অনিয়ম দুর্নীতির ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে এসেছে।
করাত কল লাইসেন্স বিধিমালা ২০১২ অনুযায়ী সকল লাইসেন্স প্রদানের এখতিয়ার বনবিভাগের। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে সংরক্ষিত, রক্ষিত, অর্পিত বা অন্য যেকোন ধরণের সরকারি বন ভূমির সীমানা হইতে ন্যুনতম ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন করাত কল স্থাপন করা যাবে না। অথচ ১০ কিলোমিটার তো দূরের কথা বনভূমীর দুইতিন শ' গজের মধ্যে রয়েছে এমন করাতকলের সংখ্যা শুধু বরগুনা জেলায় হবে অন্তত ২৫টি। পটুয়াখালী ও বরগুনা বন অঞ্চল মিলিয়ে এ সংখ্যা হবে অর্ধ শতাধিক। এসব করাত কল থেকে প্রতিমাসে নিয়মিত মাসোহারা নেয় বনবিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা।
বনবিভাগের সরাসরি প্ররোচনায় বন উজারের এমন নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ অনাচারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাবের আশংকা করেছেন সচেতন মহল।
সরেজমিনে বরগুনার কুমীরমারা, গোড়াপদ্মা ও নিশানবাড়িয়ার বনভূমি ঘুরে দেখা গেছে, কোটি টাকার ভুয়া প্রকল্পের বনের ভেতর দিয়ে তৈরি দীর্ঘ কাঁচা রাস্তা। বরগুনা সদরের নলটোনা ইউনিয়নের বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী কুমীরমারা বনভূমির গহীনে কুমীরমারা খালের মৌজায় দেখা গেছে, বন বিভাগের সহস্রাধিক গাছ কেটে নির্মান করা হয়েছে ১৫ ফিট প্রশস্থ কাঁচা সড়ক। আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ এমপি গোলাম সরোয়ার টুকুর আমলে গত বছর ২০২৪ সালের শুরুর দিকে সড়কটি নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের অব্যাহত প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখেও বন্ধ হয়নি সে সড়ক নির্মাণের কাজ। আওয়ামী লীগ সরকারের ত্রাণ ও পূণর্বাসণ মন্ত্রনালয়ের কোটি টাকার প্রকল্পের অধীনে স্থানীয় প্রভাবশালীদের স্বার্থে নির্মাণ করা হয় এ সড়ক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন সাবেক ইউপি সদস্য বলেন, সড়কটি নির্মান করা হয়েছে ভুয়া প্রকল্পের অধীনে। স্থানীয় এলাকাবাসীসহ তিনি তখন এ কাজে বাঁধা দেন। কিন্তু তা কেউ শোনেনি। তিনি আরও বলেন, বনবিভাগ এ বিষয়ে কোন আপত্তি দেয়নি। বরং ওই ভুয়া প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েছে বলে আমরা শুনেছি।
কুমীরমারা গ্রামের বেড়িবাঁধ থেকে শুরু হয়ে বনবিভাগের সহস্রাধিক গাছ কেটে বনভূমি উজার করে সংরক্ষিত বনের গহীনে চলে গেছে নবনির্মিত দীর্ঘ একটি কাঁচা সড়ক। এ সড়কটি ধরে কুমীরমারা খালের মৌজায় গিয়ে দেখা গেছে, মাটি কাটার স্ক্যাভেটর দিয়ে কাটা সারি সারি মাছের ঘের, কৃষি প্রকল্প এবং টিনের তৈরি ঘরবাড়ি। স্থানীয় গ্রামবাসীর শতশত গবাদি পশুর নির্বিঘ্ন চারণভূমি সেখানে। কুমীরমারা বনভূমির পাশেই গোড়াপদ্মা বনভূমি। যেখানে জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি ডাক বাংলো করা হয়েছে। এই ডাক বাংলোর পাশ দিয়েই বনের শত শত গাছ কেটে বনের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে মাটির সড়ক। বছর দুই আগে নির্মিত এ সড়কটির অধিকাংশই জোয়ার ও জলোচ্ছাসে বিলীন হয়ে গেছে। এই সড়ক ধরেই দেখা মেলে স্থানীয় গ্রামবাসী ও তাদের গবাদি পশুর অবাধ চলাফেরা পুরো বনভূমি জুড়ে। বনবিভাগের উদাসীনতায় বেশির ভাগ সময়েই স্থানীয় মাদক কারবারিদের মাদক সেবন ও বাণিজ্যের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে এসব গহীন বনভূমি। কুমীরমারা বনভূমির পরেই নিশানবাড়িয়ার সংরক্ষিত বন। এখানেই বন উজার করে বানানো হয়েছে শতাধিক বসতবাড়ি, মাছের ঘের, গবাদিপশুর খামার।
জেলার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নে সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে মাছের ঘের করা হয়েছে। একই দৃশ্য দেখা গেছে বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী উপজেলার বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। বিশেষ করে বরগুনার আমতলী ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়নের সীমানায় কুয়াকাটা মহাসড়ক সংলগ্ন বাইপাস এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমি উজার করে মাছের ঘের এবং বসতবাড়ি বানানোর মহোৎসব দেখা গেছে।
সংরক্ষিত, রক্ষিত, অর্পিত এবং সামাজিক বনায়ন সংরক্ষণে বন বিভাগের একটি প্রকল্পের নাম সুফল প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে চলছে নজিরবিহীন অনিয়ম দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতা। বনের সাথে কোন রকম সম্পর্ক নেই এমন সুবিধাভোগী বাছাই করা হয়েছে উৎকোচ নিয়ে। এতে বাদ পড়েছে বনের সাথে সম্পৃক্ত প্রকৃত সুবিধাভোগীরা। যাদেরকে নেওয়া হয়েছে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটি টাকার সরকারি অর্থ না দিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন বনপ্রহরী, বিটঅফিসার, রেঞ্জার এবং ডিএফও এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী স্থানীয়দের।
ধরিত্রি রক্ষায় আমরা (ধরা)'র সাথে সম্পৃক্ত পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, বরগুনার পাথরঘাটায় লালদিয়ার চরে বঙ্গোপসাগরের বিস্তির্ণ জলমোহনায় মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে বন বিভাগের গাছ কেটে খুটা পুতে জাল দিয়ে চলছে মাছ ধরার বাণিজ্য। এতে একদিকে যেমন মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে তেমনি উজাড় হচ্ছে বনভূমি। খুটা জালে প্রতিদিন শত শত প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণির এক থেকে দুই টন রেনু বা পোনার মৃত্যু হয় অকারণেই। তিনি আরও বলেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে বনবিভাগের লোকজনের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
সুন্দরবন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি’র সহযোগী সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটির বরগুনা জেলার সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, ওই সময় সর্বস্তরের সচেতন মহল এবং পরিবেশ কর্মীরা বন কেটে যাতে বনের গভীরে সড়ক নির্মাণ না করা হয় সে জন্য প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। তাছাড়া এই সড়ক দিয়ে সাধারণ গ্রামবাসী ও তাদের গবাদিপশু বনের ভেতরে অবাধে চলাচল করানোয় সংরক্ষিত এ বনাঞ্চল এখন চরম হুমকির মুখে। সেসময় বন বিভাগের পক্ষ থেকেও কোন অপত্তি জানানো হয়নি। তিনি আরও বলেন, সড়কটি এমনিতেও সাগরের জলোচ্ছাসে দ্রুতই ভেঙ্গে যাবে। মাঝখান থেকে সহস্রাধিক গাছ কাটা পড়লো যা কিছুতেই ঠিক হয়নি। তিনি আরও বলেন, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বনের জমি দখল, অবৈধ করাতকল, গাছ কাটা, ক্ষতিকর খুটা জালের বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন হলেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি।
বনবিভাগের বরগুনা অঞ্চলের রেঞ্জার আক্তারুজ্জামান বরগুনায় যোগদানের পর থেকেই বনাঞ্চলের অনিয়ম দুর্নীতি বেড়ে গেছে এমন মন্তব্য খোদ বনবিভাগের অন্যান্য কর্মচারীদের। বরগুনা-পটুয়াখালী বনাঞ্চলের অভিযোগ রয়েছে, রেঞ্জার আখতারুজ্জামান প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা মাসোহারা নেন অবৈধ করাতকল থেকে শুরু করে মাছের ঘের, বসতবাড়ি এমনকি মাছ ধরার ট্রলারের দরিদ্র জেলেদের কাছ থেকেও।
এ বিষয়ে বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলতে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
কুড়িগ্রামে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার
সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা …

পানিবন্দি মানুষের পাশে রান্না করা খাবার নিয়ে ছাত্রদলের আহ্বায়ক রনি
টানা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে নলছিটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। …

কুড়িগ্রামে ট্রিপল মার্ডার ঘটনায় ওসির অপসারণ দাবিতে থানা ঘেরাও
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি,
কুড়িগ্রামের রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লুৎফর রহমানের …
