• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

দলটি কিসের উত্তরাধিকার বয়ে বেড়ায়? বঙ্গবন্ধুর, নাকি শুধুই ক্ষমতার

   ২ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫৭ পি.এম.
কবি ও সাংবাদিক জামশেদ নাজিম। ছবি- ফেসবুক

জামশেদ নাজিম

ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল পেইজে আপলোড হওয়া একটি অডিও ক্লিপ- শেখ হাসিনার ফোনালাপ। মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। তার কণ্ঠে ভেসে এলো এক অচেনা আকুতি, অসহায়ত্বের সুর। বিবিসির একটি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্যে যেন কেঁপে উঠল আমার অন্তর- এই কি সেই দুর্দমনীয় নেত্রী?

তার কথা শুনে হঠাৎ মনে পড়ে গেল- ৫ আগস্টের সেই সকালটা। আমি তখন শহরের অলিগলিতে সাংবাদিক হিসেবে খবরের পেছনে ছুটে চলা এক সাধারণ মানুষ। খবরে তখনো গুঞ্জন; শেখ হাসিনার সরকারের শেষ দিন আজ। ইতিহাসের সবচেয়ে ভারী, অথচ সবচেয়ে নিঃশব্দ একটি নতুন ইতিহাস রচনা হতে যাচ্ছে। কল্পনা করিনি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন,‌ দলের শীর্ষ নেতারা একে একে বিদেশে পাড়ি জমাবেন, পুলিশ, সাংবাদিক, এমনকি মসজিদের ইমাম সাহেব পর্যন্ত গা ঢাকা দেবেন। দুপুর গড়াতেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। রাস্তার মোড়ে পড়ে রইলো আওয়ামী লীগের পতাকা, বিবর্ণ ব্যানার আর নিস্তব্ধ শ্লোগান। মানুষের কণ্ঠে তখন একটাই প্রশ্ন- “আওয়ামী লীগ কোথায় গেল?”

আর মাত্র দুই দিন, তারপর এক বছর পূর্ণ হবে। যে দল এক সময় বুক চিতিয়ে আন্দোলন করেছে, যাদের নেতৃত্বে এসেছিল স্বাধিকার আর স্বাধীনতার সংগ্রাম- তারাই একদিন সবচেয়ে কঠিন সময়ে পেছন ফিরে হাঁটল। পালিয়ে গেলো— নেতৃত্ব, সংগঠন, নৈতিকতা— সব ফেলে রেখে। সেই এক বছরের পূর্তিতে প্রশ্ন জাগে— আসলে দলটি কিসের উত্তরাধিকার বয়ে বেড়ায়? বঙ্গবন্ধুর, নাকি শুধুই ক্ষমতার?

একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ইতিহাসে এক বছর কেবল সময় নয়- এটি দায়িত্ববোধ, সাহস আর প্রতিজ্ঞার মানচিত্র। আর সেখানে যদি থাকে নিঃশব্দ পালানো, আত্মগোপন, আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতি— তবে সময় তার শিরোনাম ঠিক করে দেয়। 

“পালিয়ে যাওয়ার এক বছর”— এটাই হয়তো লেখা থাকবে আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সবচেয়ে ভারী, সবচেয়ে বিব্রতকর অনুচ্ছেদে। এই একটি বছর— লাখো নেতাকর্মীর মনে হাজারো প্রশ্ন জমে আছে আগুন হয়ে। কেউ বলেনি, কেউ পারেওনি। আমিও না।‌ চুপ থেকেছি— অপেক্ষায় ছিলাম, যদি কোথাও একটিবার সত্যের স্বর ভেসে আসে। আসেনি। হয়তো কেউ ভাবেনি, অতি সাধারণ মানুষ অথবা সমর্থনকারীদের হৃদয় গহীনে লুকিয়ে থাকা আর্তনাদ।

এখন আগস্ট মাস। এই মাস এলেই মন ভার হয়ে আসে— শুধু আমার নয়, যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, সবারই। কিন্তু আজ আর 'শোকের মাস' লেখা পোস্টার দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অলিতে গলিতে বাজে না গান, শোনা যায় না ভাষণের রেকর্ড। চারপাশে ছড়িয়ে আছে এক অজানা নিঃশব্দতা।
আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে আগস্টের শোককে হৃদয়ে ধারণ করেছি, তাদের কাছে এই নিস্তব্ধতা এক ধরনের ব্যথা। হয়তো এক সময়কার অতিরিক্ত আয়োজন মানুষের মধ্যে ক্লান্তি এনেছিল।

হয়তো আওয়ামী লীগ বোঝেনি— শ্রদ্ধা কখনও চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাই আজো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে, আওয়ামী লীগকে আর মনে রাখতে চায় না। এই ক্ষয় শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নয়— এটি ইতিহাস, আত্মপরিচয় আর বিশ্বাসের ক্ষরণ। কখনো কখনো ইচ্ছে হয়— আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে সরাসরি জানতে চাই—এইভাবে একটি দল ধ্বংস করে, কী পেলেন আপনারা? একটি বিশ্বাসকে এতটা ঠুনকো করে তোলার দায় নেবেন কে?

আওয়ামী লীগ কেবল একটি রাজনৈতিক দল ছিল না— এটি ছিল অনেকের আশ্রয়, অনেকের আস্থা, একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। বঙ্গবন্ধুর নাম যেই দলের সঙ্গে জড়িত— সে দল কি এভাবে নির্বাক, নিঃস্ব, নির্বাসিত হয়ে যাবে? এক বছর কেটে গেছে। কিন্তু দলের কেউ কি স্বীকার করেছে—
"হ্যাঁ, আমরা ব্যর্থ হয়েছি"? "হ্যাঁ, আমরা জনগণকে প্রতারিত করেছি"? না, কোনো নেতা কর্মীদের আচরণে প্রকাশ পায়নি, তারা অনুতপ্ত, লজ্জিত!  শুধু সময় এগিয়েছে। যেমন এগোয় কোনো পরিত্যক্ত রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে একটা পুরোনো ট্রেন— ধীরে, নিঃশব্দে। এই এক বছরে কী দেখেছি? যারা দেশ ছেড়ে যাননি— অনেকে আজ জেলে। যারা চুপ থেকেছেন— তারা বেঁচে আছেন আতঙ্কে। দলীয় নেতৃত্বের জায়গা ফাঁকা। চেনা মুখগুলো অদৃশ্য। কোথাও নেই আত্মসমালোচনার সভা, নেই নতুন দিনের স্বপ্ন। আওয়ামী লীগের পতন কেবল ক্ষমতার পতন নয়— এটি একটি প্রজন্মের বিশ্বাসচ্যুতি।

আজ যখন দেশ নতুন করে নিজের কাঠামো গড়ছে,‌তখন আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত।‌ তারা কী জবাব দেবে সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে, যারা এই দেশটাকে স্বাধীন করেছে। যারা, এখনও বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে ধারণ করে?

একদিন যারা বলত, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স”— আজ তারা নিজেদের অন্যায় স্বীকার করতেও অস্বীকৃত। নেতৃত্ব যদি নিজের ভুল না দেখে, আত্মসমালোচনায় ভয় পায়—‌ তবে তা জনগণের নয়,‌ শুধুই ক্ষমতার নেতৃত্ব।

আগস্ট মাস কোনো ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়— এটি একটি জাতির রক্তাক্ত স্মৃতি, সংঘর্ষ, বিশ্বাস ও বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছবি। এই মাসেই আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকন্যার দৃপ্ত নেতৃত্ব, তেমনি দেখেছি সেই নেতৃত্বের একাকীত্ব, দম্ভ আর অনুশোচনার অভাব। প্রশ্ন রয়ে যায়— আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কি নেতৃত্বের এই ব্যর্থতা স্বীকার করবেন? যখন দল ছিন্নভিন্ন, নেতারা কারাগারে, তখনও কি তারা মুখ খুলবেন না?

দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও তৈরি হয়নি বিকল্প নেতৃত্ব, বিকশিত হয়নি জবাবদিহির সংস্কৃতি।‌দলটি ব্যক্তি-নির্ভর হয়ে পড়েছিল—‌ আর সে ব্যক্তি যখন চলে গেলেন, দলটিও নিভে গেল।
আওয়ামী লীগ যদি ফিরতে চায়—‌ তবে তা শুরু হোক ক্ষমা চাওয়া দিয়ে, আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে, আর নেতৃত্ব হস্তান্তরের সাহসিকতায়— একটি নতুন, সৎ ও জনগণের সঙ্গে যুক্ত প্রজন্মের হাতে। নইলে ইতিহাস আওয়ামী লীগকে মনে রাখবে একটি ব্যর্থ উত্তরাধিকার হিসেবে— যারা সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু সব খুইয়ে ফেলেছিল।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

ভিওডি বাংলা/ এমপি

[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়]

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে
সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে
দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি — কথা রেখেছেন মাহেরীন
দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি — কথা রেখেছেন মাহেরীন
লজ্জা পাচ্ছে, আবার নীরবে প্রতিরোধও করছে
লজ্জা পাচ্ছে, আবার নীরবে প্রতিরোধও করছে