তারিখটা বদলায়নি, কিন্তু সকালটা আগের মতো নেই !


আজ ৩ আগস্ট। তারিখটা বদলায়নি, কিন্তু সকালটা, আগের মতো নেই। গেল ক’দিন ধরে গত বছরের প্রতিটি দিন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়— নীরব, অথচ গুমোট এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়— “আমরা কেন সব কিছু আবেগ দিয়ে বিচার করি?”
এই আবেগের নাম— আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সেই দল, যার নাম উচ্চারণে কখনো গৌরবের দীপ্তি জাগে, আবার কখনো বুক ভরে ওঠে দীর্ঘশ্বাসে। আজকাল আমার মাথায় বারবার ঘুরপাক খায় একটি প্রশ্ন— শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, নাকি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা? এই প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে আওয়ামী লীগের বর্তমান বাস্তবতা— তার রাজনৈতিক চরিত্র, আদর্শ থেকে বিচ্যুতি, এবং কীভাবে একটি দল ব্যক্তি-নির্ভর হয়ে পড়লে কী পরিণতি ঘটে— তার নির্মম চিত্র।
একদিন যে দল ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাহক, আজ তা পরিণত হয়েছে এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্তনির্ভর এক সংগঠনে। শেখ হাসিনার প্রতিটি সিদ্ধান্ত দল নিঃশর্তে মেনে নিয়েছে— প্রশ্ন ওঠে, এটা কি আদর্শগত বোধ থেকে, নাকি কেবল আনুগত্যের ঘোরে? আজকের আওয়ামী লীগ কতটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বহন করে, আর কতটা শেখ হাসিনার কৌশলের বাহক— এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি— শেখ হাসিনার সরকারের পতনের জন্য দায়ী সাধারণ মানুষ নয়, এমনকি আওয়ামী লীগের তৃণমূলও নয়। দায় সেই শীর্ষ নেতৃত্বের, যেখানে ভুলের কোনো সুযোগ ছিল না, অথচ প্রতিটি ভুল রক্তাক্ত করেছে গোটা কাঠামোকে। আজ সেই তৃণমূল নেতাকর্মীরাই ঘরছাড়া, পলাতক, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে— যাদের খোঁজ রাখে না কেউ। অথচ এমপি-মন্ত্রীদের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট নিয়ে মিডিয়া মুখর। কিন্তু দলের জন্য জীবন দেওয়া কর্মীদের জন্য নেই কোনো খোঁজ, কোনো খেদ।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো— এই পলাতকদের অনেকেই সরকারের সময়ে কোনো পদ-পদবিও পাননি। বরং ছিলেন অবহেলিত, বঞ্চিত, উপেক্ষিত। আজ তারা নিখোঁজ, আত্মগোপনে, অনাহারে। অথচ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বিকার, যেন কিছুই হয়নি।
আর শেখ হাসিনা? আজ অনেকের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘পালিয়ে যাওয়া’ এক নাম। যদিও দলীয় আনুষ্ঠানিকতা, বিদেশ সফর আর উৎসবে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় নেতারা বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে মোটেও বিচলিত নন। কারণ, সিদ্ধান্ত তো একজনের— আর আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে ‘জ্বী আপা’ বলাটাই যেন দায়িত্ববোধের একমাত্র প্রমাণ।
ঠিক এক বছর আগে এই দিনেই আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম এক ভয়াবহ রাজনৈতিক মোড়। ‘এক দফা’ আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিল সাধারণ মানুষ, তরুণ প্রজন্ম, এমনকি সরকার-সমর্থকদের সন্তানেরাও। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, বিচারহীনতা, প্রশাসনের দলীয়করণ ও সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা বলেছিল, “এই সরকার থাকতে পারে না।”
সত্যি বলতে, আমি চেয়েছিলাম— সরকার শান্তিপূর্ণভাবে সরে যাক। রক্ত নয়, বরং কল্পনা করেছিলাম সম্মানজনক বিদায়। সেই ভাবনা থেকেই এক ঘনিষ্ঠ সূত্র ব্যবহার করে আমি একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেখানে বলা হয়েছিল, বিএনপিসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে—
"এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, আমার বিরুদ্ধে। তাই আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। আসুন, সম্মিলিতভাবে একটি শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের পথ খুঁজি। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আওয়ামী লীগ যেকোনো দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত— প্রয়োজনে আমি থাকবো না।”
মেসেজ পাঠানোর কিছুক্ষণ পর একটি কল এসেছিল। ওপাশে কান্নাভেজা কণ্ঠ— আর কিছু কথা শুনলাম। আমি আর কিছু না বলে কল কেটে দিয়েছিলাম। কিছু সময় পরে জার্মান থেকে এক অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক আমাকে বলেন, "শেখ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য দেশ ত্যাগ করেছেন। বিষয়টা নিশ্চিত করে একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে।"
আমাকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে— শেখ হাসিনা ও তার বোন ছাড়া প্রায় সবাই দেশ ছেড়েছেন। দলের অনেক নেতা-কর্মীও পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিজের অজান্তেই আমার মুখে একটুখানি হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে যায়, যখন মনে পড়ে—এই তারাই তো গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনাকে বলেছে, ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’, ‘জননেত্রী’, ‘কাণ্ডারী’।
এরাই দেড় দশক ধারাবাহিক ভাবে দেশের সঠিক তথ্য শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছায়নি। বরং ঘিরে থাকা সুবিধাবাদীরা প্রতিদিন তার সামনে এক রঙিন প্রশংসার আয়না ধরে রেখেছিল। আর সেই আয়নায় প্রতিদিন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে দেখে শেখ হাসিনা ভুলে গিয়েছিলেন— আয়না কখনো বাস্তবতা দেখায় না, শুধু প্রতিচ্ছবিই দেখায়। এই আত্মপ্রশংসার বিভ্রমে আচ্ছন্ন হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দিনকে দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাস্তবতা, জনমানস এবং আদর্শ থেকে। বিশেষ করে—
একচ্ছত্র ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ প্রকৃত বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা নির্বাচনের প্রহসন আন্দোলনের নির্মম দমন অন্ধ আনুগত্য প্রশাসনের দলীয়করণ
এই প্রতিটি সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউ তাকে বোঝাতে পারেনি— এই দেশ, এই জনগণ, এই ইতিহাস কোনো একক নেতার সম্পত্তি নয়।
আজ যেমন দিল্লি থেকে ফোন করে নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলা হচ্ছে, তখনও কেউ বোঝায়নি— তিনি ভুল করছেন। তিনি কাউকে কদ দিলে বিপদে পড়ে যাবে। এই একনায়কতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ও শূন্য আত্মসমালোচনার সংস্কৃতিই আজকের আওয়ামী লীগকে এক পরিত্যক্ত কাঠামোয় পরিণত করেছে। ঘুরে ফিরে আবার সেই প্রশ্ন— শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি, নাকি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা?
বারবার এই প্রশ্নই বলে দেয়— আওয়ামী লীগ আজ কোনো আদর্শ নয়, একটি ব্যক্তির সিদ্ধান্তের সমষ্টি। তবে ইতিহাস বলে—প্রশ্ন কখনো চাপা থাকে না। একদিন কেউ না কেউ বলবেই— “ভুল ছিল। ভুলের মাশুল আমরা দিচ্ছি। কিন্তু নেতৃত্বও দায় এড়াতে পারে না।”
রাজনীতির সবচেয়ে করুণ চিত্র হলো— নেতৃত্ব পালিয়ে বাঁচে আর কর্মীরা পথে মরতে থাকে। আজকের আওয়ামী লীগে তাই-ই দেখা যাচ্ছে। এই পতন হঠাৎ আসেনি— অতীতের কর্ম দোষে এটি ছিল অনিবার্য। দীর্ঘ দেড় দশকে আত্মসমালোচনা, প্রশ্ন, ভিন্নমত—সব নিঃশেষ করা হয়েছে। প্রশ্ন করলেই “বিরোধী?” ভুল ধরালে “ষড়যন্ত্রকারী?” এমন এক সংকীর্ণ দল তৈরি হয়েছে, যেখানে কেউ আর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায় না।
আর যখন বাস্তব ঝড় আসে— রাজপথে মানুষ নামে, কর্মীরা নিখোঁজ হয়, তখন নেতারা দেশ ছাড়েন। যারা বলেছিল, “আপার জন্য জীবন দেবো”— তারা আর ফিরে তাকায় না সেই কর্মীর দিকে, যে রক্ত দিয়ে দলকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এই কি তবে আওয়ামী লীগ? এই কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দল? না—এটা এক নির্মম প্রহসন।
এক ছায়া, যা আদর্শের আলো গিলে খেয়েছে।
নেতৃত্ব পালায় ইতিহাস থেকে, দায়িত্ব থেকে, ভবিষ্যৎ থেকেও। আর সেই শূন্যতাই পুড়িয়ে ফেলে তৃণমূলের বুক। আজ বঙ্গবন্ধু থাকলে হয়তো বলতেন— “আমার দল কোথায় গেল? কেন তারা পালাল?” আজকের আওয়ামী লীগ মানে— ভয়ের সংস্কৃতি, ভুলের দায়হীনতা, তৃণমূলের কান্না। প্রায়ই ভাবি— যদি আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থাকতাম, কী করতাম? জানি— ভুল করেন একজন, কিন্তু মাসুল গুনতে হয় পুরো দলকে। আমাদের রাজনীতিতে কেউ ভুলের দায় নেয় না, শুধু দায় চাপায়। তবে কি, শেখ হাসিনা ভুল করলেও সমালোচনা নিষিদ্ধ, আত্মসমালোচনা নিষ্পৃহ।
সেই প্রশ্ন থেকে মনে হয়, আমি যদি দলে থাকতাম, নির্ভয়ে বলতাম— “আপা, আপনি ভুল করছেন। দেশের মানুষ এটা সইবে না। আপনার পাশে যারা আছে, তারা আপনাকে ভালোবাসে না। তারা কেবল আপনার ব্যর্থতাকে উৎসবে ঢেকে দিতে জানে।”
এসব বলে হয়তো আমি পদ হারাতাম। সুযোগ পেতাম না। তবু চুপ করে আগুনে ঠেলে দিতাম না দলকে। আমি দেখেছি—কীভাবে এক বছরে তৃণমূল নিঃস্ব হয়েছে। কেউ ঘরছাড়া, কেউ আত্মগোপনে, কেউ অনাহারে। এই মানুষগুলো একদিন রাজপথে মার খেয়েছে, ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়েছে। আর আজ তারা পরিত্যক্ত।
এই কি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অর্জন?
যদি দলে থাকতাম, কণ্ঠ তুলতাম। বলতাম— “আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন আপা। দল, কর্মী ও দেশ— তিনটিই আজ আপনার নেতৃত্বে নিঃস্ব।” কারণ, দল মানে একজন ব্যক্তি নয়— দল মানে হাজারো মানুষের সম্মিলিত চেতনা। এই চেতনা নষ্ট হলে ধ্বংস হয় বিশ্বাস, ইতিহাস। আজকের ৩ আগস্ট কেবল একটি স্মৃতির দিন নয়— এটি একটি গভীর উপলব্ধির দিন, এক অনিবার্য প্রশ্নের দিন। এবং— জবাবদিহির সূচনার দিন। সেই মঞ্চ কাঁপিয়ে ফেলা বক্তারা, যারা একসময় গর্জে উঠতেন আদর্শের নামে, দলের নামে— আজ তারা কোথায়?
আপনারা যারা দেশের মাটি ছেড়ে পালিয়ে আছেন, নিরাপদ দূরত্ব থেকে হুটহাট করে বক্তব্য ছুড়ে দেন— "রেডি থাকুন, ঢাকা ঘেরাও হবে খুব শীঘ্রই!" —আপনাদের ঘৃণা হয় না? লজ্জা লাগে না? নিজেরাই বিদেশে বসে, আর দেশের ভেতরে রেখে যান সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তি, ভয় আর নিরাপত্তাহীনতার মুখে। আপনাদের এমন কথার পর কী ঘটে, জানেন? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। গ্রেফতার হয় শত শত কর্মী— যাদের অনেকেই হয়তো জানেই না ঘেরাও কী, কবে, কোথায় হবে। কারও বাসায় রাতদুপুরে হানা পড়ে, কেউ কর্মস্থল থেকে হারিয়ে যায়, কেউ নিখোঁজ হয় দিনের আলোয়। আপনাদের সেই একটি 'বিপ্লবী’ বক্তব্যের খেসারত দিতে হয় মায়ের একমাত্র সন্তানকে, শ্রমিক বাবার তরুণ ছেলেকে, কিংবা ছাত্রাবস্থায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া এক সম্ভাবনাময় তরুণকে।
আপনারা কবে বুঝবেন— বিপ্লব ফেসবুক পোস্ট বা ইউটিউব লাইভে হয় না। বিপ্লব হয় মাঠে, মানুষের হৃদয়ে, বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে। আপনি যখন পেছন ফিরে দেশ ছেড়ে যান, তখন আপনি শুধু নিজের ভীতুর পরিচয়ই দেন না, আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও খাটো করেন। দয়া করে থামুন। যারা দেশে রয়ে গেছে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে খেলবেন না। সাহস থাকলে ফিরে আসুন— রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিন। আর না পারলে নীরব থাকুন। কারণ দেশজুড়ে যাদের ওপর ঝড় বয়ে যায়, তারা আপনাদের সেই ‘রেডি থাকুন’ টাইপ বক্তৃতার দায়ে প্রতিদিন মূল্য দিচ্ছে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ভিওডি বাংলা/ এমএইচপি/ এমপি