রাজশাহীতে পটল চাষে অগ্রগতি, বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য


রাজশাহীতে কৃষিক্ষেত্রে সবুজের বিপ্লব ঘটেছে। প্রচলিত ধান-পাট চাষের পাশাপাশি কৃষকরা এখন লাভজনক সবজি উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো পটল চাষ, যা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে পবা উপজেলার পুঠিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক মামুন ও মোফার সাফল্য অন্যদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ। এর ফলে জেলায় গতবছরের তুলনায় এ বছর পটলের আবাদ ১৪০ হেক্টর বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর পটলের আবাদ ১৪০ হেক্টর জমিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর ৮৪৬ হেক্টর জমিতে পটল চাষ হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা ৮৫০ হেক্টর ছাড়িয়ে ৯৮৬ হেক্টর জমিতে পটল আবাদ হয়েছে।
চলতি মৌসুমে মামুন ৩০ শতক জমিতে মাচা পদ্ধতিতে পটল চাষ শুরু করেন। ২৫ হাজার টাকা প্রাথমিক বিনিয়োগ করে তিনি নিবিড় পরিচর্যা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দ্রুত লাভের মুখ দেখেন। ইতোমধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার টাকার পটল বিক্রি করেছেন তিনি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং বাজারদর ভালো পেলে, আগামী সাড়ে তিন মাসে আরও এক লাখ থেকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। বাজারে প্রতি কেজি পটলের গড় দাম ২০-২৫ টাকা থাকায় তার এই সাফল্য অন্যদেরও উৎসাহিত করেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় পবা উপজেলার পূর্ব পুঠিয়াপাড়া বিলে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক মামুন বাজারজাত করণের জন্য পটল উত্তোলন করছেন। এই সময় কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, “অনেকেই প্রথমে বলেছিল পটল চাষে লাভ হবে না, কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল। ২৫ হাজার টাকা খরচ করে এখন পর্যন্ত ৫৫ হাজার টাকার পটল বিক্রি করেছি। আশা করছি, দাম ভালো পেলে আরও প্রায় এক লাখ টাকার পটল বিক্রি করতে পারবো। এখন অন্য কৃষকরাও আমার দেখাদেখি পটল চাষে ঝুঁকছেন দেখে খুব ভালো লাগে। নতুন কিছু চেষ্টা করলে যে ভাগ্য বদলায়, এটাই তার প্রমাণ।”
মামুনের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে একই গ্রামের কৃষক মোফা প্রায় এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে পটল চাষ শুরু করেন। তার মোট বিনিয়োগ প্রায় ৩০ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনি প্রতি সপ্তাহে জমি থেকে ১৩ থেকে ১৫ মণ পটল তুলছেন।লাভের হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৪ মণ বা ৫৬০ কেজি পটল উৎপাদন করছেন মোফা। প্রতি কেজি সর্বনি¤œ ২০ টাকা দরে বিক্রি করলেও তার সাপ্তাহিক আয় হয় ১১,২০০ টাকা। এই হিসাবে মাসিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৪,৮০০ টাকা। তিনি আশা করছেন, আগামী চার মাস এই ফলন অব্যাহত থাকবে, যা থেকে তার মোট আয় হতে পারে প্রায় ১ লাখ ৭৯ হাজার ২০০ টাকা। মৌসুম শেষে খরচ বাদ দিয়ে তার নিট মুনাফা হতে পারে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
মোফা বলেন, “প্রথমদিকে কিছুটা ভয় থাকলেও কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও নিজের পরিশ্রমে এখন ভালো ফল পাচ্ছি। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় সব কষ্ট সার্থক মনে হচ্ছে।”
রাজশাহীর অন্যতম বড় পাইকারি বাজার পবার খড়খড়ি ও নওহাটা বাজারে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পটলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। পটলের ব্যাপারী পিয়ারুল জানান, তারা প্রতিদিন সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা মণ দরে পটল কিনে ঢাকায় পাঠান। নওহাটা বাজার থেকে সপ্তাহে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ ট্রাক পটল ঢাকায় পাঠানো হয়, যা এই সবজির ব্যাপক চাহিদার প্রমাণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, “মাচা পদ্ধতিতে চাষের ফলে পটল মাটি ও পানির সংস্পর্শে আসে না, যা রোগবালাই কমায় এবং গুণগত মান বাড়ায়।” বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি বিভাগ কম সেচের ফসল হিসেবে পটল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছে।
তিনি আরও বলেন, মামুন ও মোফার মতো কৃষকদের সাফল্য এখন অন্য কৃষকদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে রাজশাহীর কৃষি অর্থনীতি ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এবিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এম. এ. মান্নান জানান, এই অঞ্চলের কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পটল চাষের আধুনিক কৌশল, বিশেষ করে মাচা পদ্ধতির চাষাবাদ, হাতে-কলমে শেখানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “আমরা মাঠপর্যায়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করি এবং কৃষকদের যেকোনো সমস্যায় তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ