• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ জাতির অহংকার

ভিওডি বাংলা ডেস্ক    ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৪:৪৯ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
আজকের তরুণরা অনেকেই কি জানে, দারুল উলূম দেওবন্দ পড়ুয়া মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ছিলেন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সভাপতি। যার অধীনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। সময়কাল : ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি। দলটির প্রথম সভাপতিও যে আরেকজন দেওবন্দপড়ুয়া আলেম, সে কথা না হয় আজ অনুল্লেখ্য রইল। আবদুর রশিদ তর্কবাগীশই ১৯২৩ সালে মহানবী (সা.)- এর বিরুদ্ধে রচিত অশ্লীল গ্রন্থ ‘রঙ্গীলা রসুল’ এবং আর্যসমাজের শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংঘটিত করে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে সময় তিনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এতো বেশি বাহাস (বিতর্কসভা) করেছেন যে, তাঁকে সাধারণ জনগণ ‘তর্কবাগীশ’ (বিতার্কিক) উপাধিতে ভূষিত করেন।

আজকের সুশীল সমাজ কি স্বীকার করবে যে, আপদমস্তক ধর্মীয় পোশাকে আবৃত এই দেওবন্দি আলেমই সর্বপ্রথম বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। আজকের শিক্ষিতসমাজ কি জানে যে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদের (জাতীয় সংসদ) প্রথম সভাপতি হিসাবে মাওলানা তর্কবাগীশ সর্বপ্রথম বাংলায় যে সংসদীয় কার্যপ্রণালী প্রবর্তন করেন তা আজও চালু আছে। জি, তিনিই হলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। আওলাদে রাসুল রাসুল নোমা হযরত মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.) এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা শাহসূফী আবু বকর সিদ্দিকী আল কোরাইসী, ফুরফুরাবী (রহ.) এর অন্যতম খলিফাও ছিলেন তিনি।

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সমগ্র জাতির অহঙ্কার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রিাতষ্ঠায় তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ১৯২২ সালে উপমহাদেশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের রক্তাক্ত অধ্যায় ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা বিদ্রোহে’ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেদিনের তরুণ বিপ্লবী আবদুর রশীদ। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আশির দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অবধি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গোড়াপত্তন যে-ভাষা আন্দোলনে, তার গোড়ায় ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। যে-রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তারও নেতৃত্ব দিতে কুন্ঠিত হননি তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নামটি তাই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। দুর্নীতি-দুবৃত্তায়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে তিনি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আমাদের অনুপ্রেরনার উৎস। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তসিঁড়ি সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক, ঋণসালিশী বোর্ড প্রবর্তনের পথিকৃৎ, বর্গা আন্দোলনের অবিসংবাদিত কান্ডারি, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে অকুতোভয় যোদ্ধা এই মহান নেতা, আজীবন গণমানুষের নেতা।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নামটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গোড়াপত্তন যে-ভাষা আন্দোলনে, তার গোড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। যে-রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তারও নেতৃত্ব দিতে কুন্ঠিত হননি তিনি। তাঁকে ভুলে যাওয়া মানে হচ্ছে অকৃতজ্ঞ জাতি হিসাবে নিজেদের প্রমান করা।  

তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন৷ পরবর্তীকালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগ দেন। মাওলানা তর্কবাগীশ পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত ছাত্র জনতার উপর পুলিশী নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন ৷ তিনি ১৯৫২ সালে ২২শে ফেব্রুয়ারি মুসলীম লীগ ত্যাগ করে প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দল গঠন করেন এবং নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন। পরের দিন তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৫৫ সালের ১২ই আগস্ট তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান  জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতার পর গঠিত হয় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি। এ সমিতির প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদক হন মাওলানা খোন্দকার নাসির উদ্দিন। অতঃপর মাওলানা সাহেব বাংলাদেশ ইসলামী শিক্ষা সংস্কার ও মাদ্রাসা শিক্ষক শীর্ষক এক সম্মেলন করেন। এ সম্মেলনে ইসলাম শিক্ষা সংস্কার সংস্থা নামে একটি সংস্থা গঠন করে নিজে সংস্কার সভাপতি, মাওলানা আলাউদ্দিন আল আজহারীকে সাধারণ সম্পাদক এবং সাতজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করেন। পরে ড. কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনের একটি উপকমিটি হিসেবে সংযুক্ত হয় এ সংস্থা। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে মাওলানা তর্কবাগীশ মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যম করেন বাংলা।

১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত রাশিয়ার আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে প্রথম প্রেরিত মাওলানা তর্কবাগীশের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাশিয়া গমন করে। রাশিয়ার রিলিজিয়াস কাউন্সিল কর্তৃক ‘ইসলাম’ শীর্ষক বক্তৃতায় অংশগ্রহণের জন্য মাওলানা তর্কবাগীশ বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হন। কাউন্সিলের অধ্যক্ষের সভাপতিত্বে মাওলানা সাহেব দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা ইসলাম সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। তার এ বক্তৃতা উচ্চপ্রশংসিত হয়। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, লুবুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন এবং রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে সোভিয়েত রাশিয়ার জনসাধারণ, বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে মহান ব্যক্তি ও মহান দেশ হিসেবে তিনি এবং বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করে।

১৯০০ সালের ২৭শে নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার তারুটিয়া গ্রামে জন্ম নেয়া আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী এর বংশধর। শৈশব থেকেই তার মধ্যে দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে অসহায় দুধ বিক্রেতাদের সংগঠিত করে দুধের ন্যায্যমূল্য প্রদানে মহাজনদের বাধ্য করেন।

১৯১৯ সালে তিনি খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯২২ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী ঐতিহাসিক 'সলংগা আন্দোলন'-এ নেতৃত্ব দান করেন, যার জন্য তাকে কারাভোগ করতে হয়। এই 'সলংগা আন্দোলন' ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে "রক্তসিঁড়ি" হিসেবে পরিচিত ৷ ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত বাংলার এম.এল.এ হিসেবে তৎকালীন ব্যবস্থাপক পরিষদে পতিতাবৃত্তি নিরোধ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ও বিনা ক্ষতি পূরেনে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি নির্মাণে যে সব মনীষী কালজয়ী অবদান রেখেছেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম৷ তিনি একজন সুসাহিত্যিকও ছিলেন ৷ তার রচিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে : শেষ প্রেরিত নবী, সত্যার্থে ভ্রমণে, ইসলামের স্বর্ণযুগের ছিন্ন পৃষ্ঠা, সমকালীন জীবনবোধ, স্মৃতির সৈকতে আমি, ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইত্যাদি ৷ জাতীয় ইতিহাসের এই ব্যক্তিত্ব ১৯৮৬ সালের ২০শে আগস্ট ইন্তেকাল করেন।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ মরহুম মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে "স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০০" (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি বেতার ও টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াতের নিয়ম চালু করেন। এ ছাড়া তিনি কৃষক আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলনসহ দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে সব মুক্তির আন্দোলনে সরাসরি সামনে থেকে জাতির অধিকার আদায়ে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন আজীবন। স্বীয় মেধা প্রজ্ঞা ও যুক্তি দিয়ে ইসলাম ও মুসলিম জাতি জাগরণে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।

আমাদের এই প্রজন্মের রাজনীতি আমাদের পূর্বপুরুষ তর্কবাগীশদের মতো মানুষের স্বাধীনতার ও কল্যাণের রাজনীতি হোক। বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত হোক,অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হোক- সেটাই কামনা। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক 

ভিওডি বাংলা/ এমপি

[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়]


  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
গণঅভ্যুত্থান, ৫ আগস্ট ও  হাসিনার পতন
গণঅভ্যুত্থান, ৫ আগস্ট ও  হাসিনার পতন
সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে
সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে
দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি — কথা রেখেছেন মাহেরীন
দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি — কথা রেখেছেন মাহেরীন