রাজশাহী পাটের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন কৃষকের চোখে


চৈত্র-বৈশাখ মাসে যে সোনালী আঁশের স্বপ্ন বুনেছিলেন রাজশাহীর কৃষকরা, চার মাসের নিবিড় পরিচর্যা শেষে আষাঢ়-শ্রাবণে এখন সেই ফসল ঘরে তোলার পালা। মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টির শঙ্কা এবং ব্যয়ের অনিশ্চয়তার মুহূর্ত কাটিয়ে রাজশাহীর পাটচাষিরা এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। স্বরূপে আষাঢ়ের বৃষ্টির আশির্বাদে কেবল পাট জাগ দেওয়ার সংকটই কাটেনি বরং সোনালী আঁশের মানও হয়েছে উন্নত। ফলে কৃষকের প্রত্যাশা এখন উর্ধ্ধমুখি। বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার সাথে এবার পাটের ভাল দাম পাওয়ার হাতছানি কৃষকের সামনে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহীর পবা, মোহনপুর ও দুর্গাপুরের মতো বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠজুড়ে এখন সুস্খ-সবল পাটের সমারোহ। কৃষকেরা কোমর পানিতে নেমে পাট কাটা, আঁটি বাঁধা, জাগ দেওয়া এবং আঁশ ছাড়ানোর কঠোর পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সাধারণত ফাল্গুনের শেষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কৃষকরা সঠিক সময়ে বীজ বপন করে পরিচর্যা শুরু করেন। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় পাটের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭,১৮৫ হেক্টও জমি। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড পরিমাণ ১৭,৩০৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১২০ থেকে ১৪০ দিনের জীবনচক্র শেষে আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি থেকে পুরোদমে পাটকাটা শুরু হয়েছে, যা চলবে শ্রাবণ মাসজুড়ে। মাঠ থেকে পাট কেটে এনে এখন জাগ দেওয়া, আঁশ ছাড়ানো এবং শুকানোর কাজে ব্যস্ত কৃষক পরিবার। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার সার্বিক ফলন ভালো হয়েছে।
মৌসুমের শুরুটা অবশ্য কৃষকদের জন্য অনুকূলে ছিল না। ফাল্গুন-চৈত্রে বীজ বপনের পর তীব্র খরায় পাট গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। অনেক কৃষককে বাড়তি খরচ করে গভীর নলকূপ থেকে সেচ দিতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল পাট জাগ দেওয়া নিয়ে। পর্যাপ্ত পানির অভাবে পাট পচালে আঁশের মান নষ্ট হয়ে যায়, রঙ কালচে ও আঁশ শক্ত হয়ে বাজারে দাম অর্ধেকে নেমে আসে। তবে আষাঢ় মাসজুড়ে বৃষ্টি সেই চিত্র পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। খাল-বিল, নদী-নালা ও ডোবাগুলো এখন পানিতে কাণায় কাণায় পূর্ণ।
স্বস্তির কথা শোনা গেল পবা উপজেলার পাইকপাড়া এলাকার কৃষক শহিদুল ইসলামের কণ্ঠে। তিনি বলেন, “মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির অভাবে পাট নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। সেচের খরচও দ্বিগুণ হচ্ছিল। আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছে। এই বৃষ্টিতে ডোবা-নালা ভরে যাওয়ায় এখন পাট জাগ দেওয়া নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই। পানির অভাবে জাগ দিলে পাটের রঙ কালো হয়ে যায়, আমরা বলি ‘কালো-পাট’, যার দাম বাজারে কম। এখনকার পানিতে জাগ দিলে পাটের আঁশ হবে লম্বা, নরম আর ধবধবে সাদা। এই পাটেরই আসল কদর।”
এ বছর পাটের উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি। বীজ, সার, কীটনাশকের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শ্রমিক সংকট ও মজুরি। দর্শনপাড়া ইউনিয়নের কৃষক সেলিম রেজা তাঁর খরচের হিসাব তুলে ধরে বলেন, “এক বিঘা জমিতে এবার প্রায় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন পাট কাটা থেকে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত ১০-১২ জন শ্রমিকের মজুরি বাবদই গুনতে হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। দিনমজুরের রেট এখন ৫০০-৬০০ টাকার নিচে নয়।”
তবে এই বিপুল খরচের বোঝা সত্ত্বেও তিনি হতাশ নন। তিনি যোগ করেন, “খরচ বেশি হলেও আল্লাহর রহমতে বিঘায় ফলন ১০ থেকে ১২ মণ হবে আশা করছি। আর বৃষ্টির কারণে পাটের যে মান হয়েছে, তাতে ভালো দর পেলে সব খরচ পুষিয়ে আমাদের ভালো লাভ থাকবে।”
পাটের দাম প্রসঙ্গে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মাঠ ও বাজার পরিদর্শক সুমন্ত জানান, জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে মানভেদে বর্তমানে প্রতি মণ পাট ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি মৌসুমের শুরুর দাম। পুরোদমে উন্নত মানের সাদা পাট বাজারে এলে দাম আরও বাড়বে বলে তারা ধারণা করছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। তিনি জানান, “চলতি মৌসুমে পাটের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং ফলনও খুব ভালো হয়েছে। কৃষকদের দুশ্চিন্তার কারণ ছিল পাট জাগ দেওয়া, যা সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ কেটে গেছে। এতে আঁশের মান উন্নত হবে, যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাটকলগুলোর চাহিদা এবং বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব আঁশ হিসেবে পাটের কদর বাড়ায় আমরা আশা করছি, চাষিরা এ বছর লাভবান হবেন।”
পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এম. এ. মান্নানও জানান যে, পর্যাপ্ত পানিতে পাট জাগ দেওয়ায় আঁশের রঙ ও গুণগত মান চমৎকার হচ্ছে। কৃষকরা সঠিকভাবে শুকানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারলে বাজারে নিঃসন্দেহে ভালো দাম পাবেন।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ