দরিদ্র পরিবারের তৃষ্ণা রানী এখন দেশের ‘গোলমেশিন’


দিনমজুর বাবার ঘামে ভেজা গা, মায়ের না খেয়ে থাকা দিন-এমন কষ্টের গল্প নিয়েই বড় হয়েছেন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ভাসাইনগর গ্রামের মেয়ে তৃষ্ণা রানী। অভাব-অনটনের সংসারে অন্যের জমিতে ছোট্ট একটি ঘরে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটি আজ বাংলাদেশের নারী ফুটবলের অন্যতম উজ্জ্বল নাম।
ছোটবেলা থেকেই তৃষ্ণার স্বপ্ন ছিল ফুটবল মাঠে ছুটে চলা, গোল করা এবং দেশকে জয় এনে দেওয়া। শুরুটা ছিল কঠিন। খেলার সামগ্রী কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না, অনেক সময় খালি পেটে অনুশীলন করেছেন তিনি। তবে পাশে ছিলেন বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল, যিনি তৃষ্ণাকে নিজের স্বপ্নের মতো লালন করেছেন।
কঠোর পরিশ্রমের ফল মিলেছে মাঠে। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভুটানের বিপক্ষে জোড়া গোল ও লাওসের বিপক্ষে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করে আলোচনায় আসেন তৃষ্ণা। গোলের পর গোল করে তিনি ক্রীড়ামোদীদের চোখে হয়ে উঠেছেন দেশের ‘গোলমেশিন’।
২০২২ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পান তিনি। এরপর সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন সাফ অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপসহ এএফসি টুর্নামেন্টগুলোতে। বিশেষ করে ২০২৪ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে করা গোল দলকে ফাইনালে তোলে এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ এনে দেয়।
তৃষ্ণার প্রতিটি অর্জনের পেছনে লুকিয়ে আছে অভাবের গল্প। তিনি বলেন, ‘যতদূর এসেছি, এর পেছনে একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুলের বড় ভূমিকা রয়েছে। আমাদের ঘরটি আগে বসবাসের উপযোগী ছিল না, পরে জেলা প্রশাসক সংস্কার করে দেন। তবে জমিটি আমাদের নিজস্ব নয়। সরকারের কাছে অনুরোধ- যেন আমাদের জন্য একটি জমি ও ঘর করে দেওয়া হয়।’
মা সুনিলা রানীও একই আর্জি জানিয়েছেন- ‘দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। কিছুই নেই আমাদের। সরকারের কাছে চাই, অন্তত তৃষ্ণার জন্য জমিসহ একটি ঘরের ব্যবস্থা করা হোক।’
বাবা উমেস বর্মন বলেন, ‘অভাব-অনটনের কারণে মেয়েকে খেলাধুলার খরচ দিতে পারিনি। অনেক সময় না খেয়েও অনুশীলন করেছে সে। বিপুল ভাইয়ের সহযোগিতায় আজ এই পর্যায়ে এসেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের একটা ঘর ও জমির ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।’
গ্রামের মানুষও এখন গর্ব করে তৃষ্ণাকে নিয়ে। একসময় যাকে খেলতে দিতে পরিবার রাজি ছিল না, বিয়ের কথাই ভাবত- সেই মেয়েই আজ জাতীয় দলের ভরসা। খেলা থাকলে গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে মেয়েদের নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবুও লড়ে গেছি। এখন আমাদের একাডেমি থেকে ৬ জন খেলোয়াড় জাতীয় দলের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলছে। এর মধ্যে তৃষ্ণা অন্যতম। হ্যাটট্রিক করে দেশকে জয় এনে দিয়েছে সে। এটি আমাদের সবার জন্য গর্ব।’
সব প্রতিকূলতা জয় করে তৃষ্ণা রানীর এখন একটাই স্বপ্ন- দেশের হয়ে আরও গোল করা, আরও জয় এনে দেওয়া। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করা। প্রমাণ করা, স্বপ্নের কাছে দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়।
ভিওডি বাংলা/জা