দক্ষিনাঞ্চলে আড়াই মাসে পারিবারিক বিরোধে ৮ হত্যা


দক্ষিনাঞ্চলে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে পারিবারিক হত্যার ঘটনা। কখনো বাবার হাতে ছেলে, কখনো ছেলের হাতে বাবা, আবার স্বামীর হাতে স্ত্রী, মেয়ে জামাইয়ের হাতে শ্বশুরের খুনের মতো মর্মান্তিক ঘটনা একের পর এক ঘটছে। ঘটেছে প্রকাশ্যে চোখ উপড়ে ফেলার মতও ঘটনা ।এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
জুলাই, আগস্ট ও চলতি মাসের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও পিরোজপুরে অন্তত ৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।এর মধ্যে ছেলের হাতে বাবা খুনের ঘটনা ৩ টি। মা-বাবার হাতে সন্তান খুনের ঘটনা ২ টি। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনা ২ টি। মেয়ে জামাইয়ের হাতে ১টি খুনের ঘটনা ঘটে।
বরিশাল: গত আড়াই মাসে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে বরিশালে সব থেকে বেশি ৪টি হত্যার ঘঠনা ঘটে।এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ৩টি ও মহানগরে ১টি। উজিরপুরে গত ২৭ জুলাই বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক কর্মী বাবা মো. শাহ আলম খান (৬৫) হত্যা করে মাদকাসক্ত ছেলে শাহারিয়ার শিমুল (৩৫) । বাকেরগঞ্জ উপজেলায় গত ২৯ জুলাই নেশাগ্রস্থ ছেলে হাসান গাজী (২০) পিটিয়ে হত্যা করে বাবা জাফর গাজী (৪৮) ও মা নাজমা বেগম (৪০) থানায় এসে আত্মসমর্পণ করেছেন। আগৈলঝাড়া ২০ আগস্ট সামান্য কিছু টাকার জন্য শ্বশুর দুধ ব্যবসায়ী মন্টুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে কৃষ্ণ বাড়ৈ। নগরীরর ভাটিখানায় ৯ সেপ্টেম্বর যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ তাবাচ্চুম তিনথী (২৪) কে হত্যার অভিযোগ স্বামী সোয়েব মাহমুদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এছাড়া মুলাদীতে গচ্ছিত টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে বাবা আরশেদ বেপারীর নির্দেশে মেজ ছেলে রোকন বেপারী ও ছোট ছেলে স্বপন বেপারী মিলে অপর ভাই রিপন বেপারী (৫০) দুই চোখ উপড়ে ফেলে ।
পটুয়াখালী: জুলাই ও আগস্টে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে পটুয়াখালীর বাউফলে ২টি হত্যার ঘটনা ঘটে। ৩০ জুলাই পরকীয়ার সন্দেহে প্রভাষক স্ত্রী সালমা আক্তারকে (৩২) হত্যা স্বামী করে সরোয়ার হোসেন ১ আগস্ট ভোর চার টার দিকে বাউফল থানায় গিয়ে খুনের দায় স্বীকার করে। এছাড়া ২০ আগস্ট দিবাগত রাতে প্রেমের সম্পর্কের কারণে কিশোরী উর্মি ইসলামকে (১৪)শ্বাসরোধে হত্যা করে বাবা নজরুল ইসলাম,মা আমেনা বেগম বাবা ও ভগ্নিপতি কামাল হোসেন ।
পিরোজপুর: মঠবাড়িয়ায় গত ১২ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাসির উদ্দিনকে হত্যা করে মাদকাসক্ত ছেলে রিয়াজ উদ্দিন।
ভোলা: সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ছিল ভোলায় মাদ্রাসা শিক্ষক ও মসজিদের খতিব মাওলানা আমিনুল হক নোমানী হত্যাকান্ড। ৬ সেপ্টেম্বর নিজ ঘরে গেম ও মোবাইলে আসক্ত ছেলের ছেলে রেদোয়ান হক (১৭) হত্যা করেন ইমাম বাবাকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও মাদকাসক্তি এসব হত্যাকান্ডে বড় ভূমিকা রাখছে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। তবে শুধু আইন দিয়ে সব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, পরিবার ও সমাজকেও সচেতন হতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রবণতা থামাতে হলে পরিবারকে শক্তিশালী করতে হবে, মাদক নিয়ন্ত্রনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রসার বাড়াতে হবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ সাদেকুর রহমান বলেন, বরিশাল অঞ্চল নদী তীরবর্তী হওয়ায় স্থলপথে ও নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা দূর্বল হওয়ায় মাঝে মধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তড়িৎ গতিতে নেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি দেখা যাচ্ছে সেজন্য হত্যা, ধর্ষণ জনিত এসব সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় দলগতভাবে ও সামাজিকভাবে এগুলো রোধ করা কঠিন হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রশাসন দিয়ে তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবি, ও সুশীল সমাজকে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে যাতে এসকল সামাজিক অবক্ষয় ও ব্যাধি থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এবং সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন সামাজিক পরিবেশ গঠন ও বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে।
গবেষক ও সাংবাদিক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, পারিবারিক শিক্ষার কারণে বন্ধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তাই এধরনের হত্যাকান্ড ঘটছে। প্রাইমারী থেকে কলেজ পর্যন্ত পারিবাবিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের আলাদা পাঠ এবং মনিটরিং দরকার ।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ