সংগঠন গোছানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে ছাত্রদল


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে হারের পর সংগঠন গোছানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। প্রাথমিকভাবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভালো করার দিকেই দৃষ্টি তাদের। এর অংশ হিসেবে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে দুর্বলতা দূর করতে কাজ করছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
একই সঙ্গে খুব শিগগির সারাদেশের জেলা-উপজেলায় সাংগঠনিক সফর করবেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা। এ জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ৩৮টি সাংগঠনিক টিম। তারা প্রতিটি জেলা, উপজেলাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
সংগঠনের প্রাথমিক মূল্যায়ন হলো–ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ে মনোবল ভেঙে পড়েছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। শুধু ছাত্রদল নয়, এর প্রভাব পড়েছে বিএনপিতেও। দলও যুক্ত হয়েছে কারণ অনুসন্ধানে। ইতোমধ্যে দায়িত্বশীলদের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।
সাংগঠনিক বৈঠকে ক্ষোভ
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন-পরবর্তী একটি বৈঠকে উপস্থিত নেতাকর্মীরা নির্বাচনী মাঠের নানা চিত্র তুলে ধরেন। সূত্রমতে, ওই বৈঠকে বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম বকুল, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির ছাড়াও ডাকসু নির্বাচনে দায়িত্বশীল বিভিন্ন হলের সাংগঠনিক প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ছাত্রদলের জেলা পর্যায়ের কেন্দ্রীয় ২৬টি সাংগঠনিক টিমের সঙ্গেও বৈঠক করেন নেতারা। দুয়েক দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ শাখার ১২টি সাংগঠনিক টিমের বৈঠক হওয়ার কথা।
বৈঠকগুলোর সূত্র জানায়, নেতাকর্মীরা মনে করছেন, কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বিএনপির একটি অংশ ধরেই নিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্তত ছাত্রশিবিরকে ভোট দেবেন না। তাদের এই বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দলের ওই অংশের প্ররোচনায় একটি অখ্যাত জরিপ সংগঠন দিয়ে জরিপ পরিচালনাও করা হয়। তাতে বলা হয়, ছাত্রদল বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
দল ও ছাত্র সংগঠনটির আরেক অংশ বলেছে, তারা দীর্ঘ ১৭ বছর ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরও মব জাস্টিসের ভয়ে তারা ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়নি। মূলত এটাই ছিল ভুল পদক্ষেপ। বাস্তবের সামনাসামনি হতে পারেনি ছাত্রদল।
বৈঠকে উপস্থিত নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি কেমন ছিল, তা জানতে চান। কাদের পরামর্শে কোনো প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হলো, তাও জানতে চান। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ যেখানে অবাধে অর্থ খরচ করেছে, সেখানে বিএনপির মতো এত বড় দল কেন ছাত্রদলের পাশে দাঁড়াতে পারেনি, তাও জানতে চাওয়া হয়।
নেতাকর্মীরা প্রশ্ন রাখেন, যেখানে ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে ঢুকতে দেয়নি, কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়নি, এমনকি ঢাবি ছাত্রদল হল কমিটি ঘোষণার পর মব সৃষ্টি করা হয়; সেখানে কীভাবে এই নির্বাচনে অংশ নিতে হলো ছাত্রদলকে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, ঢাবিসহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না তাদের। অথচ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে আলোচনা চলছিল। নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার পর তড়িঘড়ি প্যানেল ঘোষণা করা হয়। প্রতিপক্ষ শিবির এক বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ছাত্রদল মাত্র ১৬ দিনের প্রস্তুতিতে নির্বাচনী মাঠে নামে। আবার নির্বাচনে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ‘স্টেকহোল্ডার’ যেমন– দলসমর্থিত শিক্ষকদের পুরোপুরি সম্মতি আদায়, তাদের কাজে লাগানো, সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপকে সমন্বয় করা– এসব কাজও ঠিকমতো করা হয়নি।
জাকসু নির্বাচনেও একই অবস্থা ছিল দলের। সেখানে ডাকসুর ফলের যেমন প্রভাব পড়েছে, তেমনি ছাত্রদলের একাধিক গ্রুপের মধ্যে একটি গ্রুপকে প্রাধান্য দিয়ে প্যানেল ঠিক করা হয়েছে। ফলে অন্য গ্রুপগুলো তেমন সক্রিয় ছিল না। এসব গ্রুপের মধ্যে সমন্বয় করে অধিকতর যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে পারেনি সংগঠনটি। একই সঙ্গে শিক্ষকদের মধ্যেও কোন্দল থাকায় পুরো সহায়তা পায়নি তারা।
চাঁদাবাজি ও অপকৌশলের অভিযোগ
ছাত্রদলের নির্বাচন মনিটরিং ব্যবস্থায়ও ছিল ঘাটতি। নির্বাচনের আগে নেতিবাচক প্রচারে ছিল বড় প্রতিবন্ধকতা। আবার আর্থিক সংকটেও পড়তে হয়েছে প্রার্থী ও নেতাকর্মীকে। সংগঠন থেকে তেমন সহায়তা করা হয়নি।
চলছে দোষারোপের রাজনীতি
দুই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দোষারোপের রাজনীতি বাড়ছে বিএনপির অভ্যন্তরেও। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা নিজেদের দুর্বলতার পাশাপাশি শিক্ষক রাজনীতিকেও দুষছেন। তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের শিক্ষক নেতারা সেভাবে ছাত্রদলের পাশে দাঁড়াননি।
তবে সাদা দলের একজন শিক্ষক জানান, তারা এই নির্বাচনের পক্ষেই ছিলেন না। যেখানে ছাত্রদলের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়নি, সেখানে ছাত্রদল কীভাবে নির্বাচনে যায়। এই বার্তা দলের সর্বত্র দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তা আমলে নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় শিক্ষক হিসেবে যতটুকু সহায়তা করা যায়, ততটুকু করা হয়েছে।
ঢাবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান জানান, তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। তাদের যা বলার তা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছেন।
ছাত্রদলের আরেকটি অংশের অভিযোগের তীর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দিকে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীনকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা
ছাত্রদলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, এই পরাজয়ের শিক্ষা নিয়ে তাদের আগামীতে এগিয়ে যেতে হবে। দুই নির্বাচনে যেসব ত্রুটি ধরা পড়েছে, তা সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাদের মতে, সারাদেশে বিএনপিকে নিয়ে যে অপপ্রচার চলছে, তার প্রভাবও পড়েছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে।
এই নেতারা বলেন, সবকিছু শুধরে সামনে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে। দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতে ভালো ফল করা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করে পুরো সংগঠনকে চাঙ্গা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সাংগঠনিক টিমকে নিজ নিজ দায়িত্বে এলাকায় যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
নতুন কমিটির গুঞ্জন
ঢাবি ও জাবিতে ব্যর্থতার পরপরই ছাত্রদলের নতুন কমিটির গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে পদপ্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন। নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন– কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শ্যামল মালুম, সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান, সংগঠনের সহসভাপতি ইজাজুল হক রুয়েল, খোরশেদ আলম সোহেল, রিয়াদ রহমান, শাফি ইসলাম ও এইচ এম আবু জাফর। যুগ্ম সম্পাদকদের মধ্যে মোমিনুল ইসলাম জিসান, মোস্তাফিজুর রহমান, সালেহ মোহাম্মদ আদনান প্রমুখ।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ