কমিটিহীন ১৫ বছর, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বেহাল দশা
মির্জা ফখরুল হেনস্তায় ফুটে উঠেছে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা


যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কোনো কার্যকরী কমিটি গঠিত না হওয়ায় দলের প্রবাসী নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। কমিটি না থাকায় কার্যক্রম সংকুচিত হচ্ছে এবং একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আলাদা কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে দলের জন্য কাজ করা প্রবাসী নেতারা তাদের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক সময়ে আলোচনায় এসেছে, যখন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিউইয়র্কে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বিএনপি মহাসচিব যখন বিমানবন্দরে হেনস্তা হলেন তখন পাশে ছিলেন না কোনো নেতাকর্মী। যদিও বলা হয়েছে নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরের যে গেটে অপেক্ষায় ছিলেন মির্জা ফখরুলরা অন্য গেট দিয়ে বের হতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
তবে দলের নেতাকর্মীদের সমন্বয়হীনতার কারণে এমন পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি মহাসচিবকে পড়তে হয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে। খোদ দলের নেতাকর্মীরাও এ নিয়ে কথা বলছেন।
কারণ একইসঙ্গে বিমান থেকে বের হয়ে নেতাকর্মী বেষ্টিত হয়ে নিরাপদে বিমানবন্দর ত্যাগ করেছেন জামায়াত নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। বরং মির্জা ফখরুলকে নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে বের হতে পাশে ছিলেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা।
গতকাল মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কের ঘটনার কথা তুলে ধরে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান ফেসবুকে দলের সীমাহীন সমন্বয়হীনতা ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কথা তুলে ধরেছেন।
ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, বিএনপি মহাসচিবসহ আগত প্রতিনিধিদের রিসিভ করার জন্য প্রায় পাঁচ শতাধিক বিএনপির নেতাকর্মী বিমানবন্দরের টার্মিনাল ৮-এ অপেক্ষা করছিলেন। কারণ এখন দিয়েই তাদের বের হওয়ার কথা জানতেন আগত নেতাকর্মীরা। কিন্তু প্রতিনিধি দলটি বের হয় টার্মিনাল ৪ নম্বর দিয়ে। এই গোপন সংবাদটি দূতাবাসের কেউ আওয়ামী লীগের কাউকে জানিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে ফ্যাসিবাদের দোসরদের কয়েকজন টার্মিনাল ৪-এ ঢুকে আগে থেকেই ওত পেতে বসেছিল।
তিনি আরও লিখেছেন, এই সংবাদ পাওয়ার পর বিএনপিরও ৪০/৫০ জন নেতাকর্মী টার্মিনাল ৪-এ যায়, তখন কেউ একজন তাদের এখানে ভীড় করতে নিষেধ করে এবং বলে যে প্রতিনিধি দল ড. ইউনূসের সঙ্গে ভিআইপি গেট দিয়ে বের হয়ে গেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো ইউনূস ও সরকারি কর্তাদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট থাকায় তারা ভিআইপি গেট দিয়ে পার হয়ে যেতে পেরেছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিনিধি দলের সাধারণ পাসপোর্ট থাকায় ৪ নম্বর টার্মিনাল দিয়েই বের হতে হয়েছে। এই তথ্য ফ্যাসিবাদীদের কাছে সময়মতো সরবরাহ করার ফলে তারা সেখানে অবস্থান নিয়ে এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে পরেছে।
স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান ফেসবুকে লিখেছেন, দূতাবাস ও দলের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ের অভাবে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে বিমানবন্দরে এমন ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ পাসপোর্টধারী নেতা-নেত্রীদের নিরাপত্তার অভাবে হামলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কমিটি না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতি জোরালো আলোচনা সৃষ্টি করেছে। নেতাকর্মীরা বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকনের উপর সমালোচনা করে বলছেন, তিনি নিজের অনুসারীদের নিয়ে ক্ষুদ্র কমিটি গঠন করেছেন এবং পুরনো নেতাদের বাদ দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।
অন্যদিকে, আনোয়ার হোসেন খোকন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোনো নিজস্ব বলয় তৈরি করেননি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি স্টেটে কমিটি গঠন করেছেন।
ফ্লোরিডাতে দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় এক নেতা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পুরোনো নেতারা, যারা প্রবাসে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা আজও কমিটি না পাওয়ায় বিরক্ত। দেশের বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা শুধু আন্দোলনেই নয়, অর্থনৈতিক সহায়তা ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডেও বিএনপির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু ১৫ বছরেও কমিটি না হওয়ায় তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী এই নেতা বলেন, “আমরা আশা করবো দল সব কিছু জেনে বুঝে ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি করে দিবে। কারণ কেউ তো টাকা পয়সা চায় না দল থেকে। একটু সম্মান চায়।'
এক চিঠিতে বন্ধ করা হয় দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি
কমিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে আট মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কেউ যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যানারে কর্মসূচি পালন করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়।
গত ১৭ জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন সিদ্ধান্তে অবাক হয়ে যান অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় দেশ, এখানে বিভিন্ন স্টেট কমিটির মাধ্যমে বিএনপি কাজ করছে। দলের মধ্যে একটি সেন্ট্রাল কমিটি থাকবে না, এরকম কোনো পরিকল্পনা নেই।
নেতাকর্মীদের প্রশ্ন-দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ কিংবা গুরুতর কোনো অভিযোগ না আসার পরও দল থেকে কেন কার্যক্রম পালনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। অবশ্য এমন নির্দেশনার মধ্যেও একেক বলয়ের লোকজন দলের কর্মসূচি ভিন্ন-ভিন্নভাবে পালন করে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির অতীত-বর্তমান
অনেক নেতাকর্মী জেল-জুলুমের আতঙ্কে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমালেও দলের সঙ্গেই আছেন। স্থানীয়ভাবে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। নেতাকর্মীদের বিপদে, আন্দোলনে আর্থিক সহযোগিতা করেন দেদারছে। কিন্তু বর্তমানে পদ পদবীহীন হয়ে ঘুরতে হচ্ছে দেশটিতে রাজনীতিতে সক্রিয় বিএনপি নেতাকর্মীরা।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ইতিহাস অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী কমিটি অনুমোদন পায় ১৯৯৬ সালে, ২০০৫ ও ২০১১ সালে। ২০১১ সালের পর কোন স্থায়ী কমিটি তৈরি হয়নি। ২০১৫ সালের পর কমিটি গঠনের জন্য আলোচনা হলেও তা কার্যকর হয়নি।
বিদেশে থাকলেও দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলন এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে দলের সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি সরকারের ব্যর্থতাও আছে। তবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগে আন্দোলনের পাশাপাশি দেশের আন্দোলন সচল রাখতে আর্থিক সহযোগিতা করা কর্মীদের একটা আইডেন্টিটি অবশ্যই হওয়া উচিত।
ভিওডি বাংলা/জা