টাঙ্গাইলের বিলে দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব সংকটে


টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার চারান বিল একসময় ছিল দেশীয় প্রজাতির মাছের ভাণ্ডার। এই বিলে একসময় সহজেই ধরা যেত শোল, মাগুর, ট্যাংরা, বোয়াল, পুঁটি, কই, শিং, টেংরা, গজার সহ অসংখ্য দেশীয় প্রজাতির মাছ। কিন্তু বর্তমানে এসব মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিলে এখন আর আগের মতো মাছের প্রচুর্য দেখা যায় না।
অতিরিক্ত মাছ শিকার এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফাঁদ ব্যবহার করার কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চায়না দূয়ারী, চাই, ঘুনি, বাঁশের ফাঁদসহ নানা পদ্ধতিতে প্রতিদিন হাজারো মাছ ধরা হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমেও এসব ফাঁদ ব্যবহার করায় মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
জানাগেছে, টাঙ্গাইল জেলার ২৭৭টি বিলের মধ্যে কালিহাতী উপজেলার পাছ চারান গ্রামে শ’ শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি চারান বিল। মৎস্য অভয়াশ্রমের মধ্যে চারান বিল অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন, নদী-নালা ভরাট হওয়া এবং আধুনিক স্থাপনা নির্মাণের ফলে এই বিলের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং এর সাথে জড়িত ঐতিহ্যবাহী শাপলা-শালুক ও মাছ ধরার পদ্ধতিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বছরে ৬ মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এ আইন কেউ মানছেন না। চারান বিলে এখন বেশির ভাগই মাছ ধরা হয় চায়না দূয়ারী দিয়ে। ছোট বড় মিলিয়ে দিন-রাত এই বিলে প্রায় দুই হাজারের অধিক জাল পাতা থাকে। ফলে মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখনও এ বিল থেকে শ’ শ’ মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এ বিল ঘিরে গড়ে ওঠেছে দুইটি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। আর এই সমবায় সমিতির আইডি কার্ডধারী মৎস্যজীবির সংখ্যা প্রায় ২৩০ জন। কার্ডধারী ছাড়াও আশেপাশে কয়েকটি গ্রামের কয়েকশ’ মানুষ চারান বিল থেকে মাছ শিকার ও কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। এটিই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। একটা সময় এই বিলে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ- বাতাসি, রিটা, বেতরঙ্গি, নুন্দা, চিংড়ি, বাইম, বোয়াল, রুই, কাতল, কালকুনি, গজার, মাগুর, শিং, কই, চিতল, মৃগেল, আইড়, চ্যালা, দাইতা পুঁটি, মলা পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে মাত্র কয়েক প্রজাতির মাছ। প্রতিবছরই মাছের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চারান বিল থেকে এক সময় যমুনার নদীতে প্রবেশ করা যেত। কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই বিলের পরিধি ছিল। বর্তমানে ১২০ বিঘার জমির উপর হলেও বর্ষার মৌসুমে প্রায় ৭-৮শ’ বিঘার বিস্তীর্ণ এলাকা এলাকা জুড়ে পানিতে প্লাবিত হয়।
সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) কর্তৃক পরিচালিত সর্বশেষ কালিহাতীর চারান বিলে ‘ইকোলজি ফর লাইফ’ (ঊঋখ) বা ‘জীবনের জন্য বাস্তুসংস্থান’ নামের একটি প্রকল্প চলমান ছিল- তারা পাখি পর্যবেক্ষণ এবং চারান বিলের পরিবেশগত অবস্থা নিয়ে কাজ করেছে। এই প্রকল্পটি ২০১৪-১৫ সালের দিকে চারান বিলের বাস্তুতন্ত্র এবং সেখানকার জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণমূলক কাজ করেছিল। এছাড়াও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই চারান বিলে প্রকল্প দিয়ে কাজ শুরু করলেও সেই প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ তুলছেন স্থানীয়রা।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, কয়েকশ’ বছরের পুরানো চারান বিল একসময় স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল। বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে মাছ ধরার দৃশ্য, নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা, জলাভূমি ভরা শাপলা-শালুক, পাখির কলকাকলি সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ এই বিল তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। জবরদখলে চারান বিলের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। দখলদারদের দৌরাত্ম্যের কারণে বিলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে- ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাছের অভয়ারণ্য। চারান বিল দখল-দুষণে পর্যুদস্ত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে এই ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি। চারান বিল রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। বিলে খনন কাজ পরিচালনা করে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করা গেলে এটি আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। পাশাপাশি বিলের আশপাশের পরিবেশকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলারও সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিনে একাধিক জেলে জানান, চারান বিলে কিছুদিন আগেও প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বছরে ৬ মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বছরে ৬ মাস নিষিদ্ধ থাকলেও সারাবছরই সবাই মাছ ধরে, কেউ আইন মানে না। কারণ মাছ না ধরলে জেলেরা খাবে কি? এই বিল থেকে মাছ ধরা কয়েকশ’ জেলের জীবিকার প্রধান উৎস। যখন মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে তখন সরকার থেকে জেলেদের কোনো প্রকার প্রাণোদনা দেওয়া হয়না। তাহলে জেলেরা সংসার চালাবে কীভাবে? আর এই বিলে জেলে ছাড়াও অনেক মানুষ জাল দিয়ে মাছ ধরে সংসার চালায়। ফলে দিন দিন চায়না দূয়ারী জালের সংখ্যাও বাড়ছে।
স্থানীয় জেলে কবীর জানান, চারান বিলের ব্যাপ্তি মোটামুটি পাঁচ মাইল বলে তিনি জানেন। বিলে আগে প্রচুর পরিমানে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বাতাসি, রিটা, বেতরঙ্গি, নুন্দা, চিংড়ি, বাইম, বোয়াল, রুই, কাতল, কালকুনি, গজার, মাগুর, শিং, কই, চিতল, মৃগেল, আইড়, চ্যালা, দাইতা পুঁটি,মলা নিয়মিত ছিল। এমন কি মাঝে মধ্যে তারা ইলিশ মাছও ধরতেন। কিন্তু এখন এত মাছ পাওয়া যায় না। বিলে যে পরিমাণে চায়না জাল পাতা হয়- তাতে মাছ ছোট থাকতেই ধরা পড়ে। কাজেই চায়না জাল বন্ধ না করলে আগামিতে বিলে কোন মাছই পাওয়া যাবে না। পাশেই বল্লা গ্রামের তাঁতশিল্পের সব কারখানার বর্জ্য ও রঙ এর দূষিত পানি এই বিলে এসে পড়ে- এজন্যও পানিতে মাছ টিকতে পারেনা। এছাড়া এখন বিলে কমপক্ষে ছোট বড় মিলে প্রায় পাঁচশ’ নৌকা দিয়ে পর্যটকরা ঘুরে বেড়ায়। পানিতে নানা ধরণের ময়লা-আর্বজনা ফেলে- এতেও অনেক সমস্যা হয়।
কালিহাতী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আইয়ুব আলী জানান- নিষিদ্ধ চায়না, বেড় জাল, কারেন্ট জাল সহ বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী-অস্থায়ী জাল দিয়ে অতিমাত্রায় মাছ আহরণের ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে। ধীবর মৎস্যজীবী সমিতির নামে চারান বিলটি লিজ দেওয়া হয়েছে। সমিতিটি তাদের নিজেদের মতো করে সরকারি চুক্তি অনুযায়ী বিল ব্যবস্থাপনা করে থাকে। মৎস্য অফিসসহ উপজেলা প্রশাসন এবং থানার সহযোগিতায় মৎস্য আইন বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। মৎস্য অফিস থেকে মাছের পোনা অবমুক্ত, অভয়শ্রম স্থাপন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
তিনি আরও জানান, সিএনআরএস এর সহযোগিতায় চারানবিলে অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছিল- যা স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম। মাটি খনন করে গভীরতা বাড়ানো হয়েছিল, বিলটিতে স্থায়ী অভয়াশ্রমের খুঁটি এখনো বিদ্যমান। খননের ফলে বিলটিতে এখনো সারা বছর পানি থাকে। এছাড়াও সিএনআরএস কর্তৃক স্থাপনকৃত অভয়াশ্রমটি প্রতিবছর বা কয়েক বছর অন্তর অন্তর মেরামত করা হয়। সুফল ভোগীদের বিলটি লিজ প্রদান করা হয়। নিয়মিত আইন বিষয়ক প্রচার-প্রচারণা, প্রশিক্ষণ ও আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করা হয়।
এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, বছরের নির্দিষ্ট সময় মাছ ধরা বন্ধ হলে ওই কার্যক্রম জোরদার করা হবে। এজন্য জেলেদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা এবং মানবিক সহযোগিতা প্রদান করা যেতে পারে।
জীববৈচিত্র্য বিলোপের নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে- মানব সৃষ্ট দখল-দূষণ। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে ভূমি এবং এর সাথে সংযুক্ত সকল সম্পদের উপর চাপ বেড়েছে। ফলে বনভূমি ও জলাভূমি কমে গেছে এবং আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার কারণে সেখানকার অনেক জীব বিলুপ্ত হয়েছে। এর বাইরে ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে দূষণ। অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য মাটি ও পানিকে দূষিত করে চলছে এবং এ কারণে সেখানকার খাদ্য শৃঙ্খলা ধ্বংস হচ্ছে, সাথে সাথে হারাচ্ছে নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণি। শিল্প কারখানা থেকে নির্গত রঙসহ নানা রাসায়নিক বর্জ্য পানিকে বিষাক্ত করছে- যা মানুষসহ জলজ প্রাণিদের জন্য প্রাণসংহারী। দেশের প্রচলিত আইন প্রয়োগসহ জনসচেতনতা সৃষ্টি করে প্রাণির বিলুপ্তি ও দূষণ রোধ করা সম্ভব এবং এখনই তা করা উচিত।
কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. খায়রুল ইসলাম জানান, তারা নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করছেন। কয়েকদিন আগেও অভিযান চালিয়ে চারান বিল থেকে সবচেয়ে বেশি চায়না দোয়ারী জাল ধ্বংস করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের এ ধরনের অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ