এক শরতের গল্প


শরতের পড়ন্ত বিকেল। শুভ্র মেঘের ভেলা। কাশফুলের দোলানো বাতাস, ছোট্ট একটি সবুজ ও মায়া ঘেরা গ্রাম। দু’কুল বেয়ে কুল কুল করে বয়ে চলে বুড়িগঙ্গা নদী। মমতার আঁচল বিছানো ছবির মতো গ্রাম। যেখানে দু’চোখে জড়ানো থাকে কিশোর-কিশোরীদের শিউলী শুভ্রতার স্বপ্ন।
সেখানে তানিয়ার বেড়ে ওঠা। একটি আনন্দমুখর পরিবেশে দিন কাটতো। মায়ের আদর, বাবার স্নেহে মায়ার বাঁধনে মন আনন্দে ভরে থাকতো। তানিয়া কখনো বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখেনি। এই মধুর সম্পর্ককে রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলতো মনের ক্যানভাসে। সুখী পরিবারের দৃশ্য এঁকে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখতো। বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখতো, ‘উই আর হ্যাপি ফ্যামিলি। আই অ্যাম সো প্রাউড মাই মম অ্যান্ড ড্যাডি।’
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী তানিয়া। সে খুব মেধাবী। সে ছবি আঁকতে ভীষণ ভালোবাসতো। বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হতে চায়। তাই মাঝে মাঝে অদ্ভুত ধরনের ছবি আঁকতো। মনের মাধুরী দিয়ে খুব যত্ন করে একপাশে বাবা আর একপাশে মা এবং মাঝখানে নিজের ছবি এঁকে দুজনের দুটি হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। ছবি এঁকে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতো। বাবা-মা খুশিতে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলতো, ‘তুই একদিন অনেক বড় শিল্পী হবি মা।’ তানিয়ার বয়স তখন ১২ বছর। খুব সুখে-শান্তিতে দিন কাটতো। হঠাৎ একটি বদ হওয়া পরিবারের গায়ে লেগে সবকিছু তছনছ করে ফেললো।
তানিয়ার চারপাশটা যেন দিনে দিনে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। জানালার পাশে শূন্যতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো আকাশের দিকে। মাঝে মাঝে ভোরের শিশির ঝরা চোখের পাতা বেদনায় ভিজে যেতো। কোনো হাসি নেই। চোখে কেবলই শূন্যতা। কী যেন ভাবতো আর কান্না করতো।
কিছুদিন আগেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ কেন এমন হলো? এই তো সেদিনের কথা, বাবা অফিস থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত খেতো না। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতো এই বুঝি বাবা আসছে। বাবা ফিরে এলে মা হাসিমুখে এটা-সেটা এগিয়ে দিতো।তারপর একসাথে খেতে বসতো। খাবার টেবিলে বসে প্রতিদিনে ঘটে যাওয়া কত ঘটনা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতো। হাসাহাসি করতো। প্রতিদিন তানিয়ার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো বাবা। আহ্লাদের সাথে বাবার হাত থেকে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে হাসতে হাসতে দৌড় দিতো। এক অন্যরকম সুখ, অন্যরকম ভালো লাগা।
আজ আর দুজনে কেউ ভালোভাবে তানিয়াকে দেখে না। মায়ের চোখেমুখে ফুটে ওঠে বেদনার কালো মেঘ। এক বিষণ্নতার অসুখ মায়ের মনে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু কী সেই অসুখ? কেনইবা বাবা-মায়ের ভেতর দিন দিন এত ব্যবধান হচ্ছে? না, আমাকে জানতেই হবে। ভাবতে থাকে কিশোরী তানিয়া। তারও যে জীবন থেকে সব হাসি-খুশি ফুরিয়ে যাচ্ছে।
এক রাতে বাবা-মায়ের চেঁচামেচিতে হঠাৎ তানিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে ছিল। মায়ের গোঙানি শুনে দৌড়ে যেয়ে চুপিসারে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। হালকা একটু দরজা ফাঁক করে তানিয়া দেখলো, বাবা তার মায়ের গলা চেপে ধরেছে। তানিয়া কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে ভুল দেখেনি তো? এই বাবা কি সেই বাবা? কিন্তু কেন? আমার বাবা এমন হলো?
বাবার মুখ থেকে একটা কথা শুনে সে মাটিতে পড়ে গেল। বাবা চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বউ আমি আনবোই। বিয়ে যখন করেছি সংসার করার জন্যই করেছি। তোমার ইচ্ছা না হলে তুমি চলে যেতে পারো।’ তানিয়ার মা জবাব দিলো, ‘যেতাম। শুধু পারিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।’
‘কেন? তুমি যদি এতোই পারো, নিজেই মেয়ের ভবিষ্যৎ করে দেখাও না, আমাকে কেন দরকার?’ বলল বাবা।
তানিয়ার পায়ের নিচের মাটি যেন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল। তানিয়ার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। সে জানতে পারল, তার বাবা কলিগ সোহানাকে বিয়ে করেছে। তানিয়ার ছোট্ট বুকে যেন পাথর চাপা পড়লো। সারা পৃথিবী তার কাছে অন্ধকার হয়ে এলো। তানিয়া দৌড়ে এসে শুয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
সকাল হলেই তানিয়া অন্যরকম বাবাকে দেখল। এমন ভাব দেখালো যেন রাতে কিছুই হয়নি। সবই ছিল যেন দুঃস্বপ্ন। কিন্তু তানিয়া তার বাবার কাছে আগের মতো আর যেতে পারছিল না। বুকের ভেতর টুকরো টুকরো কষ্টগুলো যেন এক পাহাড়ে পরিণত হয়েছিল। বাবাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না। সে মনে মনে ভাবতে থাকল, মা তাহলে এতদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করেই সংসার করে চলেছে? জানি না, কতটা দিন এভাবে চলছে বাবা-মায়ের। অথচ আমি কিছুই বুঝিনি।
মা তাহলে আমার জন্যই হাসিখুশি থাকে। এটাকে মায়ের দুর্বলতা মনে করতো বাবা। বাবা ভাবতো, সে ছাড়া মায়ের আর কোনো গতি নেই। তাছাড়া মামাদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল না মায়ের। তাহলে তার মা কোথায় দাঁড়াবে? আমি যাই করি না কেন, তার স্ত্রী তার কাছেই থাকবে। এটা ভাবতো তানিয়ার বাবা। আমি এটা হতে দিতে পারি না। এত কষ্ট বুকে নিয়ে সারাটা জীবন বাবার সাথে থাকা ঠিক মনে করলো না তানিয়া। মা শিক্ষিত মেয়ে। চাইলে সে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আমার জন্য এত অসম্মানিত হয়ে থাকার মানে হয় না। আমি মাকে বোঝাবো।
পরের রাতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। তানিয়ার মা ভাবলো, না, এভাবে জীবন চলে না। একটা বিহিত করতেই হবে। ভোর হলেই তানিয়াকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেল। এখন মা-ই তার একমাত্র আশ্রয়। বাবা আলাদা থাকলো নতুন মায়ের সাথে। মাঝে মাঝে বাবা তার কাছে ফোন দিতো কিন্তু তানিয়া ধরতো না। বাবার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, অনেক প্রশ্ন। মাঝে মাঝে মনে হতো বাবার মুখোমুখি হয়ে কৈফিয়ত নেবে। আবার ঘৃণায় দূরে সরে যেত। বাবাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারতো না। বেশিরভাগই চুপচাপ থাকতো। স্কুলে যেতো না। পড়াশোনায় মন দিতো না। রাত জেগে ডুকরে ডুকরে কাঁদতো। স্মৃতির পাতায় সেসব দিনের কথা ভুলতে পারতো না কিছুতেই।
সামনে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। কোনো প্রস্তুতি নেই। যথাসময়ে প্রতিযোগিতা শুরু। সবাই আঁকছে। খুবই সুন্দর সুন্দর ছবি। প্রাকৃতিক দৃশ্য, নদী-পাহাড়, পাখির কলতান, গ্রামের ছবি। সুখী পরিবারের ছবি। কত কী এঁকেই চলেছে ছেলেমেয়েরা। তানিয়া কেবল আর্ট পেপার হাতে নিয়ে তুলিটা ধরে বসেছিল। কী আঁকবে সে? ভাবতে লাগল। তারপর আনমনে ছবি আঁকা শুরু করলো।
একপাশে বাবা আর মাঝখানে একটি নদী। টুকরো টুকরো ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছে নদীর কূল। নদীর অপরপ্রান্তে তার মা। দূরের এক সীমানায় একটা বিধ্বস্ত মেয়ের ছবি। এক বিষণ্নতার চাহনি তার। সেই চাহনিতে লুকিয়ে ছিল পুরুষশাসিত সমাজের হাজারো প্রশ্ন, হাজারো কৈফিয়ত। শুধু ছবি নয়, যেন জীবন্ত কাহিনি। হৃদয় ভাঙা পরিবারের করুণ কাহিনি তুলে ধরেছে ছবিতে।
প্রতিযোগিতা শেষ। খাতা দেখার পালা। বিচারকমণ্ডলি হতভম্ভ হয়ে গেল। এই শ্বাসরুদ্ধকর ছবি দেখে। প্রথম স্থান অধিকার করেছিল তানিয়া। তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো শিক্ষকেরা। এমন একটা মেধাবী মেয়ে কিছুতেই ঝরে যেতে পারে না। তাই ভাবলো, সবাই মিলে তার বাবার কাছে যাবে।
পরদিন স্কুলে যায় তানিয়া। শ্রেণি শিক্ষক ক্লাসে একটি পরিবার নিয়ে রচনা লিখতে দেন। বন্ধুরা একেক জন সুন্দর সুন্দর কথা লেখে। কেউ লেখে আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে বেড়াতে যায়, কেউ কেউ লেখে আমার বাবা-মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে গল্প করে। তানিয়া চুপচাপ খাতা ফাঁকা রাখে। চোখের কোণে অশ্রু জমে ওঠে। সময় গড়াতে থাকে। তানিয়া সত্যি করে পড়া থেকে একটু একটু দূরে চলে যায়। ভেতরে ভেতরে জমতে থাকে একাকিত্বের পাহাড়। তবুও ছোট্ট মন আশায় বুক বাঁধে। সম্পর্কটা যদি আগের মতো হয়ে যেত। তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো। মনের আয়নায় পুরোনো দিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে তানিয়ার। এভাবে তিনটি বছর কেটে গেল।
এদিকে তানিয়ার বাবা একটু একটু করে ভুল বুঝতে পারল। তানিয়ার জন্য মনটা ছটফট করছিল। ভুলের জন্য বারবার অনুতপ্ত হলো। তানিয়ার বাবা ভাবল, ডিভোর্স যখন হয়নি; তাহলে তো সে যেতেই পারে। না, আর দেরি নয়। তানিয়ার মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবো। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। সে চলে গেল তানিয়ার নানুবাড়ি। তানিয়া তখন স্কুলে ছিল। তানিয়ার বাবাকে দেখে তানিয়ার মায়ের গলাটা ভিজে এলো। তানিয়ার বাবা হাতজোড় করে বলল, ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি সব ভুল স্বীকার করে মাথা পেতে নিচ্ছি। চলো, আমরা আগের মতো আবার সংসার করি।’
তানিয়ার বাবাকে বসতে দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল। ঘরের টেবিলের ওপর তানিয়ার বাবা একটি ডায়েরি দেখতে পেলো। ডায়েরিটি ওল্টাতে থাকল। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল এক পাতায়। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকল। এক অদ্ভুত জলরঙের ছাপ। শরতের শুভ্রতা ঢেকে চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো মলিন ধূসরতা। ছবিটা ঠিক ভাসছে জলতরঙ্গে। আবছা আবছা আঁধারের মাঝে তার মায়ের বিষণ্ন চোখ। নদীর অথৈ জলে ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকায় একাকিত্বে চলছে এক কিশোরী। নদীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ে যেন কারোর বুক ভাঙা বেদনার স্পষ্ট ছাপ। নদীর কূল ঘেঁষে ছোট্ট একটা বিধস্ত বাড়ি। যেন এক দুরন্ত ঝড়ো হাওয়া ঘরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ছবির ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘পরিবার ভাঙলে সবচেয়ে বেশি ভাঙে শিশুর মন। কারণ তাদের পৃথিবীই হলো তাদের পরিবার।’
দেখতে দেখতে তানিয়ার বাবার চোখ দু’টো যেন কুয়াশার শিশিরের মতো ভিজে গেল।
শাহানাজ শিউলী
ভিওডি বাংলা/জা