• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

আউটসোর্সিংয়ের নামে শ্রম শোষণ, যেন আধুনিক দাস ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক    ৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪১ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে আউটসোর্সিংয়ের আড়ালে চলছে শ্রমিকদের নির্মম শোষণ। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ থাকায় প্রায় ছয় লাখ শ্রমিক অস্থায়ী চাকরির অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছেন। বেতন বৃদ্ধি, স্বীকৃতি, বা শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত এই শ্রমিকরা ‘আধুনিক দাস ব্যবস্থা’র শিকার। মধ্যস্বত্বভোগী ঠিকাদারি কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, আর শ্রমিকরা থাকছেন অধিকারহীন।

শ্রম শোষণের কাঠামো

দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয়, দপ্তর, ও অধিদপ্তরে স্থায়ী পদে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ইলেকট্রিক্যাল হেলপার, লিফটম্যান, আয়া, বাবুর্চি, গার্ডেনারসহ বিভিন্ন পদে শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে। এই শ্রমিকরা বছরের পর বছর কাজ করলেও বেতন বৃদ্ধি পান না, দক্ষতার স্বীকৃতি পান না এবং চাকরি হারানোর ভয়ে কাটে তাদের প্রতিটি দিন।

আউটসোর্সিং সেবাগ্রহণ নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী ১২ ধরনের খাতে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শ্রম আইন বা সরকারি কর্মচারী বিধিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু বিধিমালা ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শ্রম আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।

মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের বাণিজ্য

আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের বেতনের একটি বড় অংশ কমিশন হিসেবে গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, ৬০ জন গার্ডের জন্য সরকার বছরে এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু ঠিকাদাররা আট ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করিয়ে ২০ জন শ্রমিক কম নিয়োগ করে ৪৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা লাভ করে। এছাড়া, প্রতি শ্রমিককে ১৪ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হলেও সরকারি বরাদ্দ ১৯ হাজার ১১০ টাকা। ফলে প্রতি শ্রমিকের পেছনে পাঁচ টাকা কমিশন হিসেবে কোম্পানি নিয়ে যায়। এভাবে বছরে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা কমিশন এবং নিয়োগের নামে ছয় হাজার কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য চলছে।

শ্রমিকদের অধিকারহীন জীবন

আউটসোর্সিং কর্মচারীদের কোনো শ্রম অধিকার নেই। ওভারটাইম, বোনাস, উৎসব ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, গ্র্যাচুইটি, বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। নারী শ্রমিকরা গর্ভবতী হলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন। একজন নারী শ্রমিককে সন্তান না চাকরি—এমন অমানবিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে অনেকে বিয়ে বা সংসার গড়তে ভয় পান।

বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী এক্য পরিষদের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “সরকার শ্রমিকদের টাকা ঠিকই দিচ্ছে, কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী কোম্পানিগুলো হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতারণার হাত থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারের।”

আন্দোলন ও দাবি

শ্রমিকরা আউটসোর্সিং ব্যবস্থা বাতিল, স্থায়ী নিয়োগ এবং কোম্পানির কমিশন বন্ধের দাবিতে রাজপথে নেমেছেন। পাঁচ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর হাজার হাজার শ্রমিক প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছেন। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, “শ্রমিকরা ন্যায্য বেতন পাচ্ছেন না। ঠিকাদাররা শ্রমিকদের শোষণ করে লাভ করছে, আর সরকার নীরব।”

আইনি ও প্রতিষ্ঠানিক নিষ্ক্রিয়তা

আউটসোর্সিং প্রক্রিয়া শ্রম আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ২০১৩ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে বলা হয়েছে, ঠিকাদারি কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধন করতে হবে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নিবন্ধনহীন কোম্পানিগুলো শ্রমিক সরবরাহ করছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নীরব। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ওমর মো. ইমরুল মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, “আউটসোর্সিং শ্রম আইনের লঙ্ঘন। এটি শ্রমিকদের অধিকার হরণ করছে এবং প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার জন্যও বিপজ্জনক। শ্রমিকদের সুরক্ষা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, টেকসই অর্থনীতির পূর্বশর্ত।”

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে সুপারিশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আউটসোর্সিং শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করছে। এটি গরিব মানুষকে সরকারি চাকরি থেকে ছিটকে ফেলছে। শ্রমিকদের অধিকারের কথা শক্তভাবে বলতে হবে। তাদের জীবন থেকে আশা কেড়ে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”

আউটসোর্সিংয়ের নামে শ্রম শোষণ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে একটি গুরুতর সমস্যা। এটি শ্রমিকদের জীবনমানকে হ্রাস করছে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর জন্য হুমকি। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে আউটসোর্সিং ব্যবস্থার সংস্কার, স্থায়ী নিয়োগ, এবং কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই “আধুনিক দাস ব্যবস্থা” বন্ধ করা জরুরি। শ্রমিকদের মর্যাদা ও জীবিকার নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

ভিওডি বাংলা/ এমপি

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ-তুরস্ক পররাষ্ট্র পর্যায়ের চতুর্থ পলিটিক্যাল কনসালটেশন সম্পন্ন
বাংলাদেশ-তুরস্ক পররাষ্ট্র পর্যায়ের চতুর্থ পলিটিক্যাল কনসালটেশন সম্পন্ন
ডিএমপির ঊর্ধ্বতনে বড় রদবদল
ডিএমপির ঊর্ধ্বতনে বড় রদবদল
শেখ হাসিনার ভোট করার সব পথ বন্ধ হলো
শেখ হাসিনার ভোট করার সব পথ বন্ধ হলো