সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এক দীপ্ত মানবিক বুদ্ধিজীবীর প্রস্থান


তিনি যেমন সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন নির্ভীকভাবে। তার মৃত্যু শুধু একজন লেখকের প্রস্থান নয়-এ যেন চিন্তা, প্রজ্ঞা ও সংবেদনশীলতার এক যুগের অবসান।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নাম প্রথম দেখেছি দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকার বৃহস্পতিবারের সাহিত্য পাতায়। ওই পাতায় তার ‘অলস দিনের হাওয়া’ নামের কলাম প্রকাশ হত এবং ছোটবেলা থেকেই এটি পড়তাম। ‘সংবাদ সাময়িকী’তে বিদেশি সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি নিয়মিত লিখতেন। আমরা তখন তার মুগ্ধ পাঠক।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম, তিনি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। তখন আমরা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে দেখতে যেতাম ইংরেজি বিভাগে। অনুমতি ছাড়া পেছনের বেঞ্চে বসে দু-একটা ক্লাসও করেছি। দুজনই অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন শিক্ষকদের সংক্ষিপ্ত নামে ডাকার রীতি ছিল। আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে একজন স্যার ছিলেন, সবাই বলত, হুক স্যার। পরে জেনেছিলাম স্যারের প্রকৃত না ছিল হুমায়ুন কবীর। সংক্ষেপে হুমায়ুনের ‘হু’ আর কবীরের ‘ক’ দিয়ে বানানো হয়েছে ‘হুক’। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও সিক (SIC) স্যার নামে পরিচিত ছিলেন। আর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় “এসএমই স্যার”।
স্যার ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাকে অনেক দেখেছি, কিন্তু কখনও কথা বলার সুযোগ ও সাহস হয়নি। প্রথম কথা হয় ১৯৯৯ সালে, যখন আমি দৈনিক ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। স্যার তখন বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। একদিন রাতে ফুলার রোডের বাসায় গিয়ে দেখা করলাম, লেখার অনুরোধ জানালাম। স্যার বললেন, নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে লিখবেন। তারপর হেসে বলেছিলেন, “বিভু আমার খুব প্রিয় একজন সাংবাদিক, ওর পত্রিকা বলেই লিখব।”
বিভু মানে বিভুরঞ্জন সরকার। আমার বড় ভাই। স্বল্পায়ু ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় সব দায়িত্ব তারই ছিল।
মনজুর স্যার সেদিন চা-বিস্কুট খাইয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন আমাকে। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। ফেরার সময় স্যার আমার ফোন নম্বর চাইলেন। বললেন, “যখন লিখব, তোমাকে ফোন করব, এসে নিয়ে যেও।” দু-তিনদিনের মধ্যেই ফোন এল। সেদিন সন্ধ্যায় স্যারের বাসা থেকে লেখা নিয়ে এলাম। পরে মাসে তিনটি করে লেখা দিতেন। আমি বাসায় সম্মানির টাকা পৌঁছে দিতাম। একদিন খামটা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “শুন, টাকার জন্য আমরা লিখি না, আবার টাকা না দিলেও কিন্তু লিখি না!” স্যার ছিলেন প্রখর রসবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি অবলীলায় তির্যক বাক্য বলে যেতেন। আর মিটি মিটি হাসতেন।
দৈনিক ‘মাতৃভূমি’তে আমার কাজ করার সুযোগ দীর্ঘ হয়নি। যোগ দিয়েছিলাম ‘দৈনিক সংবাদ’-এ। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সারাদেশে যখন সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছিল, মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছিল, থানায় অভিযোগও নেওয়া হচ্ছিল না-তখন ‘সংবাদ’, ‘জনকণ্ঠ’, ‘ভোরের কাগজ’, ‘ডেইলি স্টার’, ‘প্রথম আলো’ এইসব পত্রিকায় নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছিল। সবার মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয়। দেশের এই দুর্যাগের কালে কী করা যায়, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই ছটফটানি ছিল।
আনিসুজ্জামান স্যারের পরামর্শে এবং ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক বজলুর রহমানের উদ্যোগে সেই সময় প্রথম পাতায় চালু করা হয় একটি বিশেষ মন্তব্য কলাম-‘লাঞ্ছিত মানবতা, জাগাও বিবেক, বাঁচাও দেশ।’ এই কলামে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে লিখতেন।
দুঃখের বিষয়, তখনকার অনেক খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী এই কলামে লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। কেউ বলেছিলেন, “নির্বাচনের পর এমন ঘটনা হতেই পারে।” কেউ সন্দেহ করেছিলেন, “ঘটনাগুলো বানোয়াট কি না, তা যাচাই দরকার।” কেউ বলেছিলেন, “এ বিষয়ে লিখলে বিএনপির বিপক্ষে যাবে।” কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে অনুরোধ করামাত্র লিখেছিলেন। কোনো দ্বিধা ছাড়াই। ন্যায়ের পক্ষে কলম ধরতে স্যার কখনও দ্বিধান্বিত হননি।
এরপর নানা সময় নানা ইস্যুতে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তিনি সবসময়ই ইতিবাচক ছিলেন। খুব সুন্দর করে আমার নামটি উচ্চারণ করতেন।
স্যারের ছিল বহুমুখী প্রতিভা। কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন–‘ভুবনের ঘাটে’ তার লেখা একটি প্রশংসিত নাটক। রম্যরচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে। স্যারের বড় মামা ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তার আরেক মামা ছিলেন ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস এম আলী। তিনি ছিলেন একাধারে অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, চিত্রকলার সমালোচক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, এমনকি বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টরাইটারও। স্যার খুব ভালো সাহিত্য সমালোচনা লিখতে পারতেন। চিত্রসমালোচনার পাশাপাশি তিনি নিজেও ছিলেন ভালো চিত্রশিল্পী।
দৈনিক ‘সংবাদ’-এ তার নিয়মিত কলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’ পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আশির দশকে লেখা হলেও এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। তার প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘নন্দনতত্ত্ব’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। দ্বিতীয়টি ‘কতিপয় প্রবন্ধ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।
সাতটি ছোটগল্পের বই তার প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে যা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, কারণ সাধারণত ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ আসে কয়েকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পরে। কিন্তু তিনি প্রথমেই গল্পের বইয়ের নাম ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ রেখেছেন। এরপর প্রকাশিত হয়- ‘থাকা না থাকার গল্প’, ‘কাঁচ ভাঙা রাতের গল্প’, ‘আলো ও অন্ধকার দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘সুখদুঃখের গল্প’, ও ‘বেলা অবেলার গল্প’। গল্পগুলোর নামকরণেই যেন লেখার মূলসুর ধরা পড়ে। প্রতিটি শিরোনামে বিপরীতার্থক ভাব ও জীবনের দ্বৈত সুর। প্রত্যেক নামের শেষেই আছে গল্প। এটাও যেন একটা নিরীক্ষা।
তার প্রথম উপন্যাসের নাম ‘আধখানা মানুষ’ (২০০৬)। এরপর লেখেন ‘তিন পর্বের জীবন’ (২০০৮), ‘কানাগলির মানুষেরা’ (২০০৯), ‘আজগুবি রাত’ (২০১০) এবং সর্বশেষ ‘দিনরাত্রিগুলি’ (২০১৩)। তার গল্প-উপন্যাসে বারবার ফিরে আসে ‘মানুষ’, ‘জীবন’ ও ‘রাত্রি’। অন্ধকার ও আলো, বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য জগৎ।
তিনি অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে যৌথভাবে একটি উপন্যাস লিখে। উপন্যাসের নাম ‘যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক’। যৌথভাবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার রেওয়াজ প্রচলিত, কিন্তু যৌথভাবে, তাও এক তরুণের সঙ্গে কীভাবে উপন্যাস লেখা যায়, বিষয়টি সেই সময়ে পাঠক ও সমালোচক মহলে যথেষ্ট আলোচনার খোরাক যুগিয়েছিল।
সাহিত্যে সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৬) এবং একুশে পদক (২০১৮)।
স্যার ছিলেন যথেষ্ট স্টাইলিশ। তরবারির মতো ঋজু শরীর, বাদামি কডের প্যান্ট, কালো ফুলহাতা শার্ট-মঞ্চে সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থবহ বক্তব্য দিতেন, অনেকটা আনিসুজ্জামান স্যারের মতো।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার অনেক গুণে গুণান্বিত একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত, সাহিত্যিক, সমালোচক, বোদ্ধা, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, আড্ডাবাজ, তরুণদের উৎসাহদানকারী-আরও আরও অনেক কিছুই হয়তো ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন একজন আধুনিক ও সংবেদনশীল মানুষ। আমাদের দেশে যা ক্রমেই বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে।
গত দুই মাসে আমরা বেশ কয়েকজন ক্ষণজন্মা মানুষকে হারিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছেন, যতীন সরকার, বদরুদ্দীন উমর, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আমাদের মেধা ও বোধের জগৎ ক্রমেই শূন্য হচ্ছে। মেধাবী ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলো বিলীন হচ্ছে। আগামী প্রজন্ম-যারা আশ্রয় খুঁজবে এমন চিন্তার দিকপালদের মধ্যে-তারা ক্রমেই যেন রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
বুদ্ধিজীবীহীন দেশ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাহীনদের দেশ তো মরুভূমির মতো। যেখানে বৃষ্টি নেই, ছায়া নেই, মায়া নেই, নিশ্চিত আশ্রয় নেই। আমরা ক্রমেই যেন অভিভাবকহীন হয়ে যাচ্ছি। যখন সুস্থ সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা, মানবিকতা, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা উধাও হয়ে যায়-তখন দেশও নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ যে রেনেসাঁসের বীজ বুনেছিলেন, তা বদরুদ্দীন উমর, যতীন সরকার, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামদের রক্তমজ্জায় বেঁচে ছিল। তারা ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার, উন্নতশির, নির্ভীক লেখক। এই মানুষগুলো বাংলাদেশকেই ঠিকানা মনে করেছেন-বাংলার মাটি ও মানুষই ছিল তাদের ধ্যানজ্ঞান। এদের প্রস্থান যেন একে একে নিভে যাওয়া প্রদীপ-এর পর তো দীপ জ্বালানোর আর কেউ থাকবে বলে মনে হয় না!
ভিওডি বাংলা/জা
চিররঞ্জন সরকার: নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়।