দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত
এবার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না বিএনপিতে!

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যেই ঘোষণা হতে পারে তফসিল। ইতোমধ্যে নির্বাচনের ট্রেনে উঠে পড়েছে পুরো বাংলাদেশ, প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোও। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
দলটি এরইমধ্যে আসন চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ করেছে। পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন আসনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রক্রিয়া। নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টায় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপ করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দ্বারে দ্বারে। তবে দলের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম এবার একটি পরিবার থেকে কেবল একজনকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে নতুন এক দৃষ্টান্ত তৈরি করবে বিএনপি। বহুদিন ধরেই দেশের রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাব, আত্মীয়তার সূত্রে প্রার্থী মনোনয়ন এবং রাজনৈতিক বংশানুক্রমের অভিযোগ প্রচলিত। এবার সেই ধারা ভাঙতে যাচ্ছে দলটি, যা রাজনীতির মাঠে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, অনেকের কাছে এটি ইতিবাচক বার্তাও।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’ নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করলেও, পুরোপুরি পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেতে পারেনি। তাদের মতে, বিএনপির বিভিন্ন অঞ্চলে এমন বহু ত্যাগী ও যোগ্য নেতা আছেন, যারা বিগত দেড় দশক ধরে দলের দুঃসময়ে মাঠে ছিলেন, মামলা-হামলা মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু সেসব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রেই দলের শীর্ষ নেতাদের পরিবার থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশী নির্ধারণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, দলের প্রতি নিবেদিত, ত্যাগী কর্মীরা কি কেবল নেতৃত্বের পরিবারের কারণেই বঞ্চিত হবেন?
তাদের বক্তব্য, দলের নেতৃত্ব যদি পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে মাঠের ত্যাগী ও পরিশ্রমী নেতাদের জন্য পথ আরও কঠিন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি সত্যিই পরিবারতন্ত্র ভাঙতে চায়, তাহলে পরিবার ছাড়াও দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের যোগ্যতা ও অবদানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ভাঙা সহজ নয়। বিএনপির এই নীতি ইতিবাচক হলেও, বাস্তবায়নের সময় দেখা যাবে- কতটা তারা দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারে। এটা শুধু প্রার্থিতা নয়, দলীয় সংস্কৃতির বিষয়ও। যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও পরিবারকেন্দ্রিক থাকে, তাহলে এই নীতি বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কোনো পরিবর্তন আনবে না। বিএনপিকে দেখাতে হবে যে তারা সত্যিই ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত। ’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতার পরিবারের সদস্যরাও বিগত ১৫–১৬ বছরে দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যখন মামলার কারণে বা রাজনৈতিক হয়রানিতে অনেক নেতাকে এলাকা ছেড়ে দূরে থাকতে হয়েছে, তখন তাদের স্ত্রী, পুত্র বা কন্যারা নানা উপায়ে নির্বাচনী এলাকায় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। কেউ জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কেউ কারাগারে থেকেও দলীয় কর্মীদের মনোবল ধরে রেখেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই দীর্ঘ সময়ে দলের প্রতি তাদের ত্যাগ ও নিবেদনও উপেক্ষা করা যায় না।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, 'এক পরিবার এক প্রার্থী'র এই সিদ্ধান্ত এসেছে সরাসরি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে। তিনি সম্প্রতি একাধিক সিনিয়র নেতাকে ফোন করে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন- একটি পরিবার থেকে কেবল একজন প্রার্থীই নির্বাচন করতে পারবেন। এমনকি তিনি প্রত্যেক রাজনৈতিক পরিবারকে পারিবারিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে একজন প্রার্থীর নাম নির্ধারণ করে মনোনয়ন বোর্ডে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির এই সিদ্ধান্ত পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট বার্তা। একইসঙ্গে এটি দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব বাছাইয়ের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘বিএনপির এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি করতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি একটি বড় সমস্যা। যদি বিএনপি সফলভাবে এই নীতি কার্যকর করতে পারে, তবে তা অন্যান্য দলেও প্রভাব ফেলবে এবং একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। ’
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির এই ‘এক পরিবার, এক প্রার্থী’ নীতি কেবল মনোনয়ন নীতির পরিবর্তন নয়, বরং এটি হতে পারে দলের রাজনীতিতে একটি বড় সাংগঠনিক সংস্কার। একই পরিবারের একাধিক প্রার্থীর জায়গায় যদি তরুণ ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে এটি বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে বলেও মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
ভিওডি বাংলা/ এমপি