বিতর্কিত জেলা প্রশাসক পদায়ন:
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্য কী?


গত ১৫ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফেনী জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন করেছে। এই পদায়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো, নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজনই আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান, মিজ আফছানা বিলকিস, মিজ মনিরা হক এবং ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই পদায়ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
চাপাইনবাবগঞ্জের নতুন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সোলাইমানের ক্যারিয়ার বিবেচনা করলে দেখা যায়, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করেছেন। চাকরিজীবনের শুরুতে সহকারী কমিশনার থাকা অবস্থায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যানের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। এরপর ভূমি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ছয় মাস উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উপপরিচালক হন। বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের নামে তিন কোটি টাকার সুবিধা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা করেন এবং ফিরে এসে শিল্প মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রাজউক, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের প্রকল্প ও বিদ্যুৎ বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান। এই ইতিহাস প্রমাণ করে যে, তার পদায়ন রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রভাবের মাধ্যমে হয়েছে, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মিজ আফছানা বিলকিসও আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী। সাবেক পানি সম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকায় একই মন্ত্রণালয়ে পাঁচ বছর কাজ করেছেন। পরে শেখ হাসিনার আস্থা প্রমাণের মাধ্যমে তিনি পদোন্নতি পান। এ ছাড়া আফছানা বিলকিস আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, হাটহাজারি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জাতীয় সংসদের সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকলেও রাজনৈতিক কनेकশন তার পদায়নে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মিজ মনিরা হকও বিতর্কিত প্রেক্ষাপটে পদায়িত হয়েছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দীর্ঘ পাঁচ বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জে সহকারী কমিশনার, ফেনীর সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। এই অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘনিষ্ঠতার কারণে তার পদায়ন প্রশ্নবিদ্ধ।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে। তিনি আওয়ামী শাসনামলে অর্থ বিভাগ, বাগেরহাট ও মুন্সীগঞ্জে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফেনী জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেই তিনি এক আওয়ামী লীগ নেতার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। এই কর্মকাণ্ড সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রশাসনিক দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই পদায়নগুলোকে শুধুমাত্র ক্যারিয়ার বৃদ্ধির মতো না দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও সুবিধাভোগের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করা যায়। জেলা প্রশাসক পদ হলো সরকারের মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সরকারি নীতি বাস্তবায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা, নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এই পদে সংযুক্ত। অথচ রাজনৈতিক আস্থা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে এই পদায়ন কার্যত প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে দেয়।
সমাজের বিভিন্ন মহল এই পদায়নকে অবৈধ বা অগণতান্ত্রিক হিসেবে দেখছেন। কারণ, জেলার উন্নয়ন ও সেবার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কनेकশন দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হলে প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না। ফলে স্থানীয় জনগণ ও রাজনৈতিক বিরোধীরা এর সমালোচনা শুরু করেছেন। বিশেষ করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা চট্টগ্রাম, ফেনী, মাদারীপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সমালোচনার ঝড় তোলে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই পদায়নের উদ্দেশ্য কী হতে পারে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। একদিকে বলা হচ্ছে, সরকার তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ জেলার দায়িত্বে রাখার মাধ্যমে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে। অন্যদিকে কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, পদায়নের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে "নিরাপদ" প্রশাসন নিশ্চিত করা হচ্ছে, যা সরকারের নীতিমালা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকর করতে সহায়ক হবে। তবে প্রশাসন ও জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক আস্থা ও সুবিধাভোগের ভিত্তিতে পদায়ন হলে এটি দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও নীতি বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অতীতে দেখা গেছে, যারা রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন, তারা প্রায়ই সরকারের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তারা প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি। এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমান পদায়নও প্রশ্ন উত্থাপন করছে, যে প্রশাসন কতটা স্বচ্ছ ও কার্যকর হবে।
সবশেষে বলা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফেনী জেলার জেলা প্রশাসক পদায়ন একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। যেখানে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার প্রভাব স্পষ্ট। এই পদায়নের উদ্দেশ্য হতে পারে সরকারকে মাঠ প্রশাসনে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আস্থা রাখার মাধ্যমে সরকারের নীতি কার্যকর করা। তবে দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা বজায় রাখতে হলে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধাভোগীকে নয়, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন করা উচিত।
ভিওডি বাংলা/জা