প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী রাখার পরিকল্পনা
গ্রিন সিগন্যালেই মনোনয়ন !

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচন ঘিরে বিএনপিতে চলছে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ। বিভিন্ন মানদণ্ডের নিরিখে একাধিক টিমের সংগৃহীত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রত্যেক আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে প্রতিটি বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তিনি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন, কোন ধরনের বিভেদ নয় বরং সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দল মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হবে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ঐক্যই হবে মূলমন্ত্র। বিএনপির একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, হাইকমান্ডের নির্দেশনায় বেশ আগেভাগেই প্রতিটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় কাজ শুরু করেন, জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির ৩১ দফা জনগণের কাছে তুলে ধরেন। এসব প্রার্থীদের মধ্যে কারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে লড়াই করেছেন, দল ও নেতাকর্মীদের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, দলের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে কে কত বেশি জনপ্রিয়, এসব তথ্য একাধিক টিমের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করছে তারেক রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন ঘিরে প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি প্রচারণায়ও নতুন মাত্রা আনতে যাচ্ছে দেশের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপি। নির্বাচনী মাঠের সঙ্গে এবার বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমেও সক্রিয় থাকবে দলটি। এর জন্য খুব শিগগির গঠিত হচ্ছে নতুন একটি অনলাইন ও তৃণমূলভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ গ্রাসরুটস নেটওয়ার্ক (বিজিএন)।
জানা গেছে, বিজিএনের মাধ্যমে বিএনপি দলের তৃণমূলকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে চায়। তাছাড়া এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইন প্রচার অনেক বেশি জোরদার হবে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের নানা প্রোপাগান্ডা প্রতিহত করাই বিজিএনের লক্ষ্য।
নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও দলের ভেতরে চলছে নিবিড় প্রস্তুতি, যা তত্ত্বাবধান করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে তিনি সরাসরি যুক্ত রয়েছেন মনোনয়ন যাচাই-বাছাই, প্রার্থী বাছাই এবং সাংগঠনিক মূল্যায়নের প্রতিটি ধাপে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির মনোনয়ন যাচাই-বাছাই এখন চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। তারেক রহমান নিজে প্রতিটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাংগঠনিক সক্ষমতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছেন, স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের মতামতও নিচ্ছেন।
তারেক রহমানের একটি ফোন কলই এখন “গ্রিন সিগন্যাল” হিসেবে ধরে নিচ্ছে নেতাকর্মীরা। যার কাছে এই ফোন গেছে, তিনি প্রায় নিশ্চিত মনোনয়নপ্রাপ্ত। এই প্রক্রিয়াকে বিএনপির ইতিহাসে এক নতুন ধারা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দলের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, তারেক রহমান নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিটি আসনের প্রার্থীর মাঠপর্যায়ের অবস্থান, জনপ্রিয়তা এবং ভোটার প্রতিক্রিয়া যাচাই করছেন। এমনকি স্থানীয় সিনিয়র নেতাদের বাইপাস করে সরাসরি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি।
দলীয় এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এবার শুধু সিনিয়রিটি নয়, বাস্তব গ্রহণযোগ্যতাই প্রধান বিবেচ্য। মাঠে যার জনসম্পৃক্ততা আছে, তারাই এই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল পাচ্ছেন।”
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন আসনে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রার্থী তারেক রহমানের ফোন পেয়েছেন। তারা নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণার কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রার্থীদের নাম
ঢাকা-৩ গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ঢাকা-৪ তানভীর আহমেদ রবিন, ঢাকা-৬ ইশরাক হোসেন, ঢাকা-৮ মির্জা আব্বাস, ঢাকা-১০ শেখ রবিউল আলম রবি, ঢাকা-১২ হাবিব উন নবী খান সোহেল, ঢাকা-১৩ আবদুস সালাম, ঢাকা-১৪ ‘মায়ের ডাক’ আন্দোলনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি, ঢাকা-১৫ মামুন হাসান, ঢাকা-১৬ আমিনুল হক, ঢাকা-১৮ এস এম জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
সানজিদা ইসলাম তুলিকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, কারণ তিনি বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার হন। তাকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন তারেক রহমান।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ৬০টি আসনে বিএনপি এখন “নির্ভার” অবস্থায় আছে—অর্থাৎ এসব আসনে প্রার্থী নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব বা অনিশ্চয়তা নেই। এসব আসনে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ ও অভিজ্ঞ নেতারা।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ঠাকুরগাঁও-১), ড. আব্দুল মঈন খান (নরসিংদী-২), ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩), বরকতউল্লাহ বুলু (নোয়াখালী-৩), মো. শাহজাহান (নোয়াখালী-৪), শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি (লক্ষ্মীপুর-৩), আসাদুল হাবিব দুলু (লালমনিরহাট-৩), অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (যশোর-৩), রশিদুজ্জামান মিল্লাত (জামালপুর-১), ব্যারিস্টার কায়সার কামাল (নেত্রকোনা-১), লুৎফুজ্জামান বাবর (নেত্রকোনা-৪), ফজলুল হক মিলন (গাজীপুর-৫), আমিরুল ইসলাম খান আলীম (সিরাজগঞ্জ-৫), ব্যারিস্টার মুহম্মদ নওশাদ জমির (পঞ্চগড়-১), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪), বাগেরহাট-৩ কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, টাঙ্গাইল-৫ সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু,
দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এই আসনগুলোতে প্রার্থীদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও অতীত কর্মতৎপরতা মূল্যায়ন করে প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, “যারা এলাকায় সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, তারাই এবার মনোনয়ন পাবেন। একই আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলে তাদের কর্মতৎপরতা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং স্থানীয় মতামত যাচাই করেছেন।”
দলীয় হাইকমান্ডের স্পষ্ট নির্দেশ যিনি মনোনয়ন পাবেন, সবাইকে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। কোনো প্রকার বিভক্তি বা অভ্যন্তরীণ বিরোধ বরদাস্ত করা হবে না। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভাঙলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই কঠোর অবস্থান দলের ভেতরে ঐক্য ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। অতীতে স্থানীয় কোন্দল বিএনপির নির্বাচনী সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, এবার হাইকমান্ড সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা একদিকে দলের নেতৃত্বে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনছে, অন্যদিকে প্রার্থীদের যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করছে।
একই সঙ্গে শরিক দল ও নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের বিষয়েও আলোচনা চলছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, “জোট গঠনের বিষয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে কৌশলগত সমঝোতা হতে পারে।”
এদিকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী রাখার বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হওয়ায় প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলে নমনীয়তা ও শক্তি দুটোই বাড়বে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'যদি কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন আইনি কারণে বা অন্য কোনো কারণে বাতিল হয়, তাহলে বিকল্প প্রার্থীর দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে। এই কারণেই একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি।'
দলীয় নেতারা জানান, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনীত করেছিল, যাতে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করলেও বিএনপি প্রার্থীহীন না হয়ে যায়।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ







