• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

কোন পথে এনসিপি?

নিজস্ব প্রতিবেদক    ৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৩৫ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হচ্ছে নতুন সমীকরণ। ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক বিএনপি ও জামায়াতের ‘হেভিওয়েট’ নেতা। এই শূন্যতাকে লক্ষ্য করে নতুন প্রজন্মের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও জল্পনা। দলটি কি শেষ পর্যন্ত কারও সঙ্গে জোট করবে, নাকি এককভাবেই নির্বাচনের মাঠে নামবে? নাকি নতুন তৃতীয় জোট গঠনের দিকে যাচ্ছে দলটি?

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপি ইতোমধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা পর্যায়ের বিএনপি ও জামায়াত নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, কিন্তু এবারের মনোনয়ন তালিকায় স্থান পাননি।

এনসিপির এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা চাই রাজনীতিতে অভিজ্ঞ কিন্তু জনমুখী নেতারা আমাদের সঙ্গে কাজ করুক। অনেকেই বিএনপি বা জামায়াত থেকে উপেক্ষিত হচ্ছেন, তাদের আমরা স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।”

আরও স্পষ্টভাবে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি ‘বঞ্চিত তরুণ’ বিএনপি নেতাদের এনসিপিতে স্বাগত জানিয়েছেন।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, “বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ তরুণ সমাজ। মনে করেছিলাম ভালো ভালো কিছু প্রার্থী পাব। কিন্তু বিএনপির প্রার্থী তালিকা আমাদের হতাশ করেছে। যারা ছাত্রদল, যুবদলের তরুণ নেতৃত্ব, নতুন রাজনীতি করতে চেয়েছেন, সেখান থেকে তারা খারিজ হয়েছেন।আমরা আপনাদের আমাদের নমিনেশন সাবমিশনে স্বাগত জানাই।’’

বিএনপির একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে মনোনয়ন নিয়ে কিছু নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তবে যেহেতু এটি প্রাথমিক তালিকা। এবং পরবর্তীতে পরিবর্তন আসতে পারে। তাই, চুড়ান্ত মনোনয়নের প্রত্যাশায় আছেন অনেক নেতা।

মনোনয়ন না পাওয়া একজন বিএনপি নেতা বলেন, “আমরা এখনও আশাবাদী, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। তবে রাজনীতি তো একদিনের নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটাই বড় বিষয়।”

আরেকজন সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি এবারও প্রার্থী হওয়ার আশা করেছিলেন, জানান,“মনোনয়ন না পেলে বিকল্প পথ খুঁজতেই হয়। দল ছাড়ব এমন সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়ে এনসিপির কিছু উদ্যোগ ইতিবাচক মনে হয়েছে।”

জামায়াতের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যারা “সামাজিক ন্যায়” ও “ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র”–এর মিশ্র রাজনীতি চান, তারা এনসিপির নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপি এই মুহূর্তে “তৃতীয় শক্তি” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। দলটির ঘোষিত ২৪ দফা “নতুন বাংলাদেশ” ঘোষণাপত্রে জাতীয় পুনর্গঠন, তরুণ নেতৃত্ব এবং রাজনীতির সংস্কারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ বলেন “এনসিপি বুঝতে পারছে, পুরনো দলগুলোর ভেতরে এখন মতবিরোধ ও হতাশা আছে। এ সময়ে তারা যদি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, তবে রাজনৈতিক সমীকরণ পালটে যেতে পারে।”

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন,“কেবল ভিন্ন দলের ক্ষোভপুষ্ট নেতাদের টানলেই হবে না। তাদের ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক অতীতও বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায় এনসিপির ‘পরিবর্তনের ইমেজ’ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়। এখনও দল বদল চলছে। তবে বর্তমান সময়ে ‘নতুন প্রজন্মের দল’ হিসেবে এনসিপি যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা আগের দলবদলের ধারার চেয়ে ভিন্ন। তারা কেবল দলবদল নয়, বরং “মূল্যবোধের পুনর্গঠন”–এর কথা বলছে।

একজন এনসিপি নেতা বলেন, “আমরা কাউকে কেবল নির্বাচনে জেতার জন্য আনব না। যারা জাতি গঠনে আন্তরিক, তারাই আমাদের অগ্রাধিকার।”

কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এই ধরনের ‘নেতা সংগ্রহ অভিযান’ দলীয় নীতির চেয়ে নির্বাচনী সুবিধাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। বিএনপি ও জামায়াতের অনেক বঞ্চিত নেতা এনসিপিতে যোগ দিলে দলটি স্বল্প সময়ে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে, তবে নীতিগত ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ বলেন, “বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জোট রাজনীতি আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এনসিপি যদি বিএনপি-জামায়াত বা অন্য মধ্যপন্থী শক্তির সঙ্গে একটি নীতিনির্ভর জোট গঠন করতে পারে, তবে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।”

তিনি আরও বলেন, “একক লড়াইয়ে নতুন দলগুলোর টিকে থাকা কঠিন। জোট বাধা মানে আপস নয়, বরং যৌথ শক্তি গড়া। তাই এনসিপির জন্য এটি কৌশলগতভাবে সঠিক সময়।”

মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের প্রতি এনসিপির আগ্রহ আসলে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা—পুরনো দলগুলোর ভেতরে ক্ষোভ, অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। এনসিপি সেই আকাঙ্ক্ষাকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে।

রাজনৈতিক মহলের অভিমত, নির্বাচনের আগে এই “নতুন জোটচেষ্টা” হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে— যেখানে পুরনো দলের হতাশা থেকে জন্ম নিতে পারে নতুন আশার রাজনীতি।

এনসিপির সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দলটির সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। তবে জোট গঠন হবে কি না, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।’

অন্যদিকে, এনসিপির নেতারা বারবারই বলছেন— তারা কোনো দলবাজির জোটে যাবে না, বরং ‘সংস্কার ও পরিবর্তনের রাজনীতি’ যারা করে, তাদের সঙ্গেই হাত মিলাবে।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দলটির মূখ্য সংগঠক নাসীরউদ্দিন পাটওয়ারী বলেছেন, “যে দল রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে, আমরা সেই দলের সঙ্গেই থাকব।”

এদিকে বুধবার (৫ নভেম্বর) এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,“আমরা এককভাবেই নির্বাচনে লড়ব।”

একই ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিনও। সুতরাং একদিনের ব্যবধানে দলের দ্বিমুখী বার্তায় ‘‘জোট না একক লড়াইয়ের সিদ্ধান্তে আছে এনসিপি’’ সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে এখনও।

আবার শোনা যাচ্ছে তৃতীয় জোটের বিষয়েও। বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে নতুন একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ এনসিপি। গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টিসহ ৯টি দল। জোটের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে দলগুলোর মধ্যে চলছে ধারাবাহিক আলোচনা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে “জোট” কোনো স্থায়ী ধারণা নয়। তিনি বলেন, “ইতিহাসে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো নেতাও একসময় শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে জোট করেছিলেন। আবার মুসলিম লীগের সভাপতি হয়েও কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। এটা দেশ ও জাতির স্বার্থেই করেছিলেন।”

তার মতে, ‘‘এখন এনসিপি এককভাবে লড়ার ঘোষণা দিলেও ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হলে নতুন বাস্তবতায় জোটের দরজা খোলা থাকতেই পারে। আবার এই তরুণ নেতাদের নেত্বৃত্বের জায়গাতেও আনতে হবে। সেভাবেই ভালো সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’’

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেছেন, “আমাদের নিয়ে বারবার বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোটের খবর ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। সিদ্ধান্ত হলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবেই সেটা প্রকাশ করব।’’

তার কথায় স্পষ্ট, এনসিপি এখন পর্যবেক্ষণের মোডে আছে; কার সঙ্গে, কী উদ্দেশ্যে, এবং কোন নীতির ভিত্তিতে যাবে, সেটি এখনো প্রক্রিয়াধীন।

ভিওডি বাংলা/ এমএম

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বাবার পথ ধরে সংসদে যেতে চান তরুণ নেতারা
বাবার পথ ধরে সংসদে যেতে চান তরুণ নেতারা
ভারতে ৪ বছর ধরে আটক ১৫০ জন বাংলাদেশি
ভারতে ৪ বছর ধরে আটক ১৫০ জন বাংলাদেশি
জুলাই সনদ ও জোটের তৎপরতা
জুলাই সনদ ও জোটের তৎপরতা