জুলাই সনদ-গণভোট: এই মুহুর্তের চ্যালেঞ্জ

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও সময় নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। বিএনপিসহ সমমনা জোট তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে যেমন সরে এসেছে ঠিক তেমনই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট চাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবীতে ইতিমধ্যে আন্দোরণ শুরু করেছে।
অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর গত ১৭ অক্টোবর বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে কেউ খুব বেশী অবাক হয় নাই। কিন্তু অবাকের বিষয় হচ্ছে, ২৪এর গণঅভু্যত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তারা যখন স্বাক্ষর করলো না। বিষয়টা অস্বাভাবিক বলে মনে করছে অনেকেই।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও তার পরবর্তী গণভোট আয়োজনের দাবিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে রাজপথে নানা কর্মসূচী পালন হচ্ছে। এ দাবিকে সামনে রেখে রাজনীতিতে সরব ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)ও এই বিষয়ে সরব। এই দুই রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়েছে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি এবং এরপর গণভোট আয়োজন না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না।
গণভোট ও জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি প্রদানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কার্যত মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। কেউ কেউ এটাকে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন বলে অভিমত প্রকাশ করছেন। বিএনপি বলছে, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী দাবী হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দিতে হবে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করা হবে। তারা ১১ তারিখ পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছেন, এর মধ্যে আশ্বাস না পেলে ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে বলেও তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তারা যেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিতর্কের অবসান ঘটান। সরকার কর্তৃক দেওয়া ৭ দিন সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। কিন্তু, এই সব বিষয়ে সমঝোতার কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
গত ২৮ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দু’টি বিকল্প সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। একটিতে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। নির্ধারিত সময়ে সংসদ এটি করতে ব্যর্থ হলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। অন্য বিকল্প সুপারিশটিও প্রায় একই। তবে সেখানে বলা হয়েছে, ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা হবে। না হলে কী হবে, তার উল্লেখ নেই। গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন।
গণভোট নিয়ে ইতিমধ্যে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে, এর আগে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করছে। তারা ঐকমত্যের জন্য দলগুলোকে সাত দিন সময় দিয়েছেন। জুলাই সনদ ও গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। রাজনৈতিক দল তো হাতের খেলনার মতো নয়। সংস্কার কমিশনের সব সভায় আমরা গিয়েছি। মতামত দিয়েছি। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। যেগুলো হয়নি, সেগুলো পরবর্তী পার্লামেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তা না করে তারা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’
অন্যদিকে, সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে গণভোট দিতে হবে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরেও গণভোট করতে আইনি বাধা নেই। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব।’
এমন পরিস্থিতে বিাদমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই সমস্যা সমাধাণে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, উদ্যোগ সরকারকেই গ্রহন করতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা যেন উদ্যোগ নেন। জামায়াত বলেছে, প্রধান উপদেষ্টাকেই রেফারির ভূমিকা নিতে হবে। এনসিপিসহ অন্য দলগুলোও প্রায় অভিন্ন কথা বলেছে।
জুলাই সনদ তৈরীর ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোতে সবচাইতে বেশী বেশি দ্বিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। ফলে এই দ্বিমত প্রকাশকে কেন্দ্র করে নানাভাবে বিএনপিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আকার-ইঙ্গিতে অনেকেই বলছেন আবার অনেকেই সরাসরি না বললেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, সংস্কারে বেশী করে দ্বীমত প্রকাশ করে বিএনপি নতুন করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছে। ফলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এসকল সংষ্কার বাস্তাবায়ন নিয়ে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশন প্রাথমিক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সংসদ প্রথম দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এই প্রস্তাবের সাথে বিএনপি সহমত প্রকাশ কররেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ আরও বেশ কিছু দল প্রস্তাবটিতে সহমত প্রকাশ করতে পারে নাই। তাদের দাবী জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে অন্য দলগুলো বিএনপির ওপরে অনাস্থা জনগণের সামনে প্রকাশ করেছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট ছাড়া উপায় নেই। সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লিখা বা সংবিধান বাতিলের চুড়ান্ত ক্ষমতা হলো জনগণের। ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা হলো জনগণের।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের গণভোট নিয়ে রাজনীতিতে অনৈক্য ও বিভক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের সময় একই সাথে বা জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোটের দাবী নিয়ে বিভক্তি নিরসনে জটিল পথ পরিহার করে সরকারকে আলোচনার মধ্য দিয়েই দ্রুত সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংবিধানের বিশেষ কিছু অনুচ্ছেদসহ মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হয়। তবে সংবিধান যেহেতু জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল, গণভোটে জনগণের সরাসরি মতামত যাচাই করা ছাড়া এর কোনো ধরনের পরিবর্তন করা উচিত হবে না।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে। তবে কবে এ ভোট অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়েও দলগুলোকে দ্রুতই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলগুলো আলোচনার মধ্য দিয়ে দিনক্ষণ নির্ধারণের জন্য সরকারের ওপর ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। কারণ, যখনই গণভোট হোক না কেন, তার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুতি নিতে হবে। গণভোট নিয়ে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন বলছে, গণভোট নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত পেলে যে কোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করতে প্রস্তুত।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনটা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে পঁচাত্তর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার বৈধতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ১৯৮৫ সালে সামরিক শাসক এরশাদ তার ক্ষমতার বৈধতা প্রমাণ করতে, গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। আর সর্বশেষ গণভোট হয়েছিল ১৯৯১ সালে। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব সংসদে পাস হওয়ার পর, জনগণ তা গ্রহণ করছেন কিনা তা যাচাইয়ের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। এই তিন গণভোটের অভিজ্ঞতা হলো গণভোট অনুষ্ঠিত হয় একটিমাত্র প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে। ভোটার ভোট দেবেন, ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’। গণভোটের মাধ্যমে বহু প্রস্তাবের মধ্যে থেকে বাছাই করে মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এর আগের তিনটি গণভোট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি গণভোটেই প্রক্রিয়াটি আগেই শুরু হয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতি পরিস্থিতি বিশ্লেষন করলে প্রতিয়মান হয় যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে জুলাই আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। সৃষ্ট এই সংকট সরকার কীভাবে সমাধান করবে-সেদিকেই সকল মহলের মনযোগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করে, গণভোটের বিষয়ে সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে। যেন কোনো ধরনের বিতর্ক না থাকে। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণভোটের ইস্যুতে তৈরি হওয়া বিতর্ক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন না তারা। রাজনীতিক দলগুলোরও প্রত্যাশা- বিতর্কের দ্রুত অবসানের উদ্যোগ গ্রহন করবে অন্তর্বর্তী সরকার এটাই সকলের প্রত্যাশা।
গণভোটের সময় নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও দেশের মানুষের প্রত্যাশা খুব দ্রুতই সেই বিভক্তি কেটে যাবে এবং জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হবে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এরই মধ্যে তাদের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। সেজন্য গণভোটকে আর বাধা হিসেবে রাখতে চাইবে না তারা। জনগনের আশা শিগগির গণভোটের সময় নিয়ে সুসংবাদ পাবে দেশবাসী।
(লেখক : রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক )
ভিওডি বাংলা/ এমএম
নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়।
