কুমারখালীতে চুরির অপবাদে দুই কিশোরকে রাতভর মারধর

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে দোকানে চুরির অপবাদে দুই কিশোরকে বাড়ি থেকে তুলে এনে রাতভর ব্যাপক মারধর করে আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। পরে এক বিএনপি নেতা সালিশে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন এবং এক ভুক্তভোগীর পরিবার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করলে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
রোববার রাত ২ টা থেকে সোমবার ফজরের আযান পর্যন্ত উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের তারাপুর বাজারে মারধরের ঘটনা এবং সকাল ৭টার দিকে বাজার সংগলগ্ন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাসের 'স' মিলে সালিশ বসানোর ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগীরা হলেন একই ইউনিয়নের তারপুর গ্রামের দিনমজুর রাজু হোসেনের ছেলে রাকিব হোসেন (১৭) এবং বাদশা আলমের ছেলে সাইফ হোসেন (১৭)। তারা বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা গেল শিক্ষাবর্ষে এস এস সি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়।
অপরদিকে, এ ঘটনায় রাকিবকে মারধরের ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সোমবার দুপুরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে ভিডিওটি সমকালের হাতে এসে পৌছেছে। তাতে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে রাকিবের হাত, মুখ ও গলা চেপে ধরে রেখেছেন। আরেকজন বাঁশের লাঠি দিয়ে মারধর করছে। এসময় ' আমি কিছু করি নাই, ও মা গো বলে ' চিৎকার করেন রাকিব।
জানা গেছে, রোববার সন্ধায় উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের তারাপুর বাজারের বিকাশ ও নগদ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের দাদী বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। আজাদ দোকান বন্ধ করে দাদীর বাড়িতে চলে যান। পরে রাত ১১ টার দিকে ফিরে দেখেন তার দোকানের পিছনের দরজা খোলা। ড্রয়ারে টাকা, সিগারেটসহ কিছু মালামাল নেই। এ সময় বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে আজাদ রাকিব ও সাইফকে সন্দেহ করেন। পরে তিনিসহ তার লোকজন উপজেলার নন্দলালপুর এলাকা থেকে রাত ২টার দিকে ফোনে যোগাযোগ করে রাকিব ও সাইফকে বাজারে ডেকে আনে এবং আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান, হাসানসহ বেশ কয়েকজন রাতভর কাঠের বাটাম ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ব্যাপক মরধর করে চুরির কথা স্বীকার করিয়ে আটকে রাখে।
এরপর সোমবার সকালে 'স' মিলে সালিশ বসান জগন্নাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাস। সালিশে দোকানদারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই কিশোরকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিএনপি নেতা। এরপর সাইফের মা পলি খাতুন ১০ হাজার টাকা পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা বাকী রেখে তাদের উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন। এবং সকাল ১০টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় চিকিৎসাধীন রাকিব ও সাইফ। তাদের হাত, পাঁ, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের ক্ষত। তাদের ঘিরে বসে আছেন স্বজনরা।
এ সময় আহত রাকিব হোসেন বলেন, আজাদের দোকানে আমরা নিয়মিত কেরাম খেলি। গতকাল রাতেও বাজারে ছিলাম। এরপর রাত ১১টার দিকে নন্দলালপুর ইউনিয়নে খালাদের বাড়ি গিছিলাম। পরে রাত ২টার দিকে হঠাৎ আজাদ বারবার বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে কল দিতে থাকে। পরে আমরা বাড়িতে আসলে আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান, হাসানসহ অনেকেই আমাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বাজারে যায়। সেখানে ফজরের আজান পর্যন্ত বাঁশেে লাঠি এবং কাঠের বাটাম দিয়ে ব্যাপক মারপিট করে আটকে রাখেন।
আহত সাইফ হোসেন বলেন, আমরা চুরি করিনি। তবুও সন্দেহ করে হাতে, পাঁয়ে, পিঠে সবখানে সারারাত প্রচুর মারেছে ওরা। পরে সকালে করিম মেম্বর সালিশে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করলে ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করলে ছাড়া পাই।
সাইফের মা পলি খাতুন বলেন, আমার ছেলে চুরি করিনি। তবুও অমানবিকভাবে মারেছে। চিকিৎসা করার জন্য জরিমানা মেনে নিয়ে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ছেলেকে নিয়ে প্রথমে বাড়ি এবং পরে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। আমরা এর বিচার চাই। কিন্তু করিম মেম্বররা তো প্রভাবশালী। আমাদের বিচার করে দেবে কে।
রাকিবের মা শারমিন বলেন, আমরা থানায় যাব। মামলা করব। এমন মারা কেউ মারে!
বিকেলে তারাপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আজাদের দোকান বন্ধ। বাজারে সুনসান নিরবতা। দোকানের সামনেই আজাদের বসতবাড়ির। তিনি ওই এলাকার সাজাহান শেখের ছেলে।
এ সময় অভিযোগ অস্বীকার করে দোকানদার আবুল কালাম আজাদ বলেন, দাদী মারা যাওয়ার খবর শুনে সন্ধায় দোকান বন্ধ করে চলে যায়। রাত ১১টার দিকে ফিরে দেখি পিছনের দরজা খোলা। ড্রয়ারে ৫৫ হাজার টাকা নেই, কিছু সিগারেট ও অন্যান্য মালামাল নেই। পরে খোঁজ নিয়ে রাকিব ও সাইফের প্রতি সন্দেহ হয়। এরপর সবাই মিলে ওদের ডেকে বাজারে আনলে উৎসুক জনতা মারধর করে। মারধরের পর ওরা চুরির কথা স্বীকার করলে বিএনপি নেতা করিম সকালে সালিশ বসিয়ে সমাধান করেন। সালিশে ১৫ হাজার টাকা করে দুজনকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একজন ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। তা করিমের কাছে আছে।
তবে এ বিষয়ে বাজার কোনো দোকানদার এবং স্থানীয়রা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আর অভিযোগ অস্বীকার করে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাস ( মেম্বর) বলেন, চোরকে গণপিটুন দিয়ে জনগণ আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এনেছিল। আমি তাদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তবে সালিশ করিনি। তিনি আরো বলেন, শুনেছি ৩৭ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। ৩০ হাজার টাকায় মিটমাট হয়েছে।
যেকোনো ঘটনায় আইন হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয় বলে জানিয়েছেন কুমারখালী থানার ওসি খন্দকার জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, চুরির ঘটনায় মারধরের কথা শুনেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ







