• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

​১৩ কিশোরের ১৩ মুরগি ও ২৫ পয়সা চাঁদায় পাঠাগার স্থাপন

য‌শোর প্রতি‌নি‌ধি    ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০১:০৪ পি.এম.
ছবি: ভিওডি বাংলা

যশোরের চৌগাছা উপজেলার বাড়ীয়ালী গ্রাম এক ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারের জন্য সুপরিচিত। এটি হলো বাড়ীয়ালী যুব পাঠাগার। ১৩ জন স্বপ্নবাজ কিশোরের সামান্য পুঁজি ও অদম্য ইচ্ছায় ১৯৭৭ সালের ৩০ মে যাত্রা শুরু করেছিল এই পাঠাগারটি। প্রতিষ্ঠার দিন প্রতিটি কিশোর ২৫ পয়সা করে চাঁদা দেন, যার মোট পরিমাণ ছিল মাত্র তিন টাকা পঁচিশ পয়সা (৩.২৫ টাকা)। টাকার পাশাপাশি প্রত্যেকে একটি করে মুরগি চাঁদা দেন, যা বিক্রি করে পাঠাগারের জন্য প্রাথমিক তহবিল সংগৃহীত হয়।

​তৎকালীন সময়ে গ্রামাঞ্চলে বই পড়ার সুযোগ ছিল সীমিত। এই অভাববোধ থেকেই স্থানীয় ১৩ জন কিশোর, যাদের প্রত্যেকের বয়স ছিল ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, তারা উদ্যোগ নেন একটি পাঠাগার গড়ার। তাদের সেই সামান্য পুঁজি আর সম্মিলিত প্রচেষ্টা আজ এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন নানা প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে এটি নিজস্ব ভবনে স্থিতি লাভ করেছে।

​কালের পরিক্রমায় বাড়ীয়ালী যুব পাঠাগার এখন কেবল বই রাখার স্থান নয়, এটি জ্ঞান চর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি প্রাণকেন্দ্র। বর্তমানে পাঠাগারটিতে প্রায় ১৫ হাজারের মত বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে। সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম, আত্মজীবনী, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র কর্মসংস্থানমূলক বই থেকে শুরু করে ছোটদের জন্য গল্পের বই—সবকিছুই এই পাঠাগারে পাওয়া যায়। স্থানীয় সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের প্রসারে পাঠাগারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

​পাঠাগারটি শুধুমাত্র বই বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেয়। কৃষি বিষয়ক আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয়দের মিলনকেন্দ্র হিসেবেও পাঠাগার ভবনটি ব্যবহৃত হয়। এটি গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে সাহায্য করছে। প্রতিবছর পাঠাগারটির পক্ষ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মননা, গরীব, অসহায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে সাধ্যমত সাহায্য করা হয়ে থাকে।

​পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুনশী মেহেরুল্লাহ গবেষক ও লেখক নাসির হেলাল বলেন, "আমরা যখন পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করি তখন আমি নবম শেণির ছাত্র, বাকি সকলে ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ে, গ্রামে ছিল না বিদ্যুৎ, রাস্তায় হাঁটু সমান কাঁদা একটি অজোপাড়া গাঁ। দু'দশ গ্রামের মধ্যে ভাল কোন স্কুল-কলেজ ছিল না। সে চিন্তা থেকে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা। যাতে গ্রাম বা গ্রামের আশে পাশের মানুষ অন্তত পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমরা কখনও ভাবিনি যে ২৫ পয়সা করে চাঁদা দিয়ে শুরু করা পাঠাগারটি এত বড় হবে। আজ যখন দেখি এত ছেলে-মেয়ে এখানে বই পড়তে আসে, তখন গর্বে বুক ভরে যায়।"

​বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ মন্টু জানান, পাঠাগারটি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর যশোরের  ০০১নং তালিকাভুক্তিকরণ ও বাংলাদেশের 'ক' শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রায় ১৫ হাজারের মত বই আছে। বইয়ের সংখ্যা আরও বেশি থাকত কিন্তু আধা পাকা বিল্ডিং থাকার কারনে বিগত কয়েক বছরের ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পাঠাগারটি দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে সে সময় অনেক মূল্যবান  বই নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে পাঠাগারটিতে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পাকা বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। যেখানে আছে পড়ার জন্য একটি বিশাল হলরুম ও একটি অফিস রুম। আমাদের পাঠাগারের বই বেশির অংশ জোগাড় করে দেন প্রতিষ্ঠাতা নাসির হেলাল। আর কিছু বই সরকারি অনুদান থেকে পাওয়া যায়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

পাঠাগারে পড়তে আসা ষাটোর্ধ নূরুল ইসলাম জানান, এটাকে জ্ঞানের ভান্ডার বলা চলে। আমাদের মত স্বল্প শিক্ষিত লোক এখন থেকে বই পড়ে অনেক বিষয় জানতে পারি। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়গুলো জানার জন্য অনেক ভাল ভাল বই পড়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পাই। কারণ আমাদের মত গ্রাম্য মানুষের জন্য বই কিনে পড়া সম্ভব নয়। 

জানা গেছে, পাঠাগারটিতে তিনটি জাতীয় দৈনিক, দুইটি স্থানীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন মাসিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন রাখা হয়। সংবাদ ও বিনোদনের জন্য আছে টেলিভিশন। বই পড়ার জন্য কোন সদস্য হতে হয় না বা কোন প্রকার চাঁদা দিতে হয় না। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। পাঠাগারটি প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে।  এবং যে কাউকে পড়ার জন্য ১ সপ্তাহ পর্যন্ত বই ধার দেওয়া হয়। 

পাঠাগারের পাঠক হিসেবে গ্রাম আশে পাশের স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আসেন। তবে আগের থেকে বর্তমানে পাঠেকর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। যেখানে আগে দৈনিক গড় পাঠকের সংখ্যা ছিল ৫০-৬০ জন। বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩০-৩৫ জন। পাঠকের সংখ্যার কমার অন্যতম কারণ মেবাইল আসক্ত। এছাড়া পাঠাগারটিতে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইডি অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা আসেন তাদের গবেষণা কাজে সাহায্য পাবার জন্য।

পাঠাগারটিতে ভিজিট করেছেন বর্তমান ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক ও জাতীয় সংসদ বিটের সভাপতি সাংবাদিক হারুন জামিল, ডিআরইউ এর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সভাপতি প্রার্থী সাংবাদিক মুরাসালীন নোমানী, যশোরের বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম রুকনুদৌলাহ, শাহাদৎ হোসেন কাবিলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষ্যতনামা সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, এডিসি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা, সরকারী বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী বৃন্দ।
পাঠাগারে সদস্যরা জানান, পাঠাগারের এই ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং বইয়ের সংখ্যা আরও বাড়ানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। পাঠাগারের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এর কার্যক্রম আরও বাড়ানো সম্ভব হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।

​অভাবনীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে উদ্যম এবং প্রচেষ্টা বাড়ীয়ালী যুব পাঠাগারকে আজকের অবস্থানে এনেছে, তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়। মাত্র ৩.২৫ টাকা ও তেরটি মুরগির চাঁদা থেকে ১৫ হাজার বইয়ের ভান্ডার গড়ার এই গল্পটি প্রমাণ করে যে, সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রয়াসে যেকোনও মহৎ কাজ সফল হতে পারে। বাড়ীয়ালী যুব পাঠাগার আজও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, যা নতুন প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সাহিত্যপ্রেমী পাঠকদের জন্য যশোরের চৌগাছা উপজেলার বাড়ীয়ালী যুব পাঠাগার একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক। ১৩ জন কিশোরের হাতে মাত্র তিন টাকা পঁচিশ পয়সা ও তেরটি মুরগি চাঁদা দিয়ে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এর বইয়ের সংগ্রহ প্রায় ১৫ হাজার, যা এর দীর্ঘ এবং গৌরবোজ্জ্বল যাত্রার স্বাক্ষী।

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ


  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সারিয়াকান্দিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের গণমিছিল অনুষ্ঠিত
সারিয়াকান্দিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের গণমিছিল অনুষ্ঠিত
উড়ে এছে জুড়ে বসা যাবেনা : মনিরুল ইসলাম
উড়ে এছে জুড়ে বসা যাবেনা : মনিরুল ইসলাম
আজ ১১ই নভেম্বর ঐতিহাসিক নওগাঁ দিবস
আজ ১১ই নভেম্বর ঐতিহাসিক নওগাঁ দিবস