গণভোট নিয়ে বিতর্ক
চালকের আসনে এখন অন্তর্বর্তী সরকার

গত ১৭ অক্টোবর ঘটা করে বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ স্বাক্ষর করেছে ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট। কিন্তু সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি এবং গণভোটের সময়সীমা ও সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যুক্ত করা না করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো বিভক্ত। নিজস্ব দাবি নিয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ নিয়ে চলমান অচলাবস্থার মধ্যে সরকার দলগুলোকে সাত দিনের সময় বেঁধে দেয় একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত জানাতে। সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে গতকাল সোমবার।
সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দলগুলো কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। পারস্পরিক আলোচনায় তারা অনীহা প্রকাশ করেছে। বরং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটসহ ৫ দফা দাবিতে আজ মঙ্গলবার রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা ৮টি রাজনৈতিক দল। এমন প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে জুলাই সনদ জাতির কাছে নতুন রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে এসেছিল, তা এখন দলীয় স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে। এই অচলাবস্থা নিরসনে এখন সরকারের সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে আছে পুরো দেশ। কারণ সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই এখন চালকের আসনে। সব রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্টজন ও সাধারণ মানুষের চোখ এখন সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে। বিএনপিও বলছে, সংকট নিরসনের বিষয়টি একান্তই সরকারের দায়িত্ব।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির খসড়া প্রস্তুত করলেও আদেশটি কে জারি করবেন—রাষ্ট্রপতি নাকি প্রধান উপদেষ্টা। আদেশের খসড়ায় কী থাকবে, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তা ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট হবে, নাকি তার আগে, এ নিয়েও প্রধান দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি এবং এর সমমনা কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের পক্ষে অনড়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজনের দাবিতে আন্দোলন করছে। এ ক্ষেত্রে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক দল এনসিপি রয়েছে মাঝামাঝি অবস্থানে। তাদের মতে, গণভোট নির্বাচনের আগে হতে পারে বা নির্বাচনের দিনেও হতে পারে, এ নিয়ে তাদের বক্তব্য নেই। তবে এনসিপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে সে অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। জুলাই সনদে কোনো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ না রাখার পক্ষেও দলটি।
সংকটের মূল কারণ ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ও গণভোটের সময়: ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশসহ ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। গত ১৭ অক্টোবর সংসদ ভবন চত্বরে জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। সর্বমোট ২৫টি দল ও জোট সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। কিন্তু সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশমালা নিয়েই মূলত তৈরি হয়েছে সমস্যা। সুপারিশে বলা হয়েছে, ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। আর গণভোট হবে একটি প্রশ্নে। মূল সমস্যা তৈরি হয়েছে দলগুলোর দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গণভোটে না রাখার সুপারিশ নিয়ে।
ঐকমত্য কমিশনের এমন সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশকিছু দল ইতিবাচক হলেও বিএনপি অসন্তুষ্ট। দলটি সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কিত বিষয় নির্বাচিত সংসদের ওপর ছাড়তে চায় এবং গণভোটের দাবিকে তারা ‘কুতর্ক’ মনে করে। এরই মধ্যে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা কমিশনের সুপারিশগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে একে ‘প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। বিএনপির অভিযোগ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালায় তাদের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে গণভোটের প্রক্রিয়া এবং সংস্কারের বিষয়গুলো নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে না দিয়ে তড়িঘড়ি করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের পক্ষে শক্ত অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা আমলে নিয়ে দ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে আসছে। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে অথবা নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি দলটির। এসব দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপিও দিয়েছে। দাবি আদায়ে আজ দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছে।
আলোচনায় অনীহা দলগুলোর: গত ২ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক আলোচনায় বসে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত জানাতে ৭ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিল। অবশ্য তার আগেই বিএনপিকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানায় জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদের সমন্বয়ে একটি কমিটিও গঠন করে জামায়াত। গতকাল নির্ধারিত সময় শেষ হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো বৈঠক বা সমঝোতার খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি আলোচনায় বসার জন্য ডা. তাহের জামায়াতের পক্ষে গত শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোনও করেছিলেন। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় সাড়া দেয়নি বিএনপি।
এ নিয়ে ডা. তাহের বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন করে বসার কথা অনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সঙ্গে পরামর্শ করে জানানোর কথা থাকলেও গতকাল (গত রোববার) পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতির খবর মেলেনি।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কোনো দলের সঙ্গে আমাদের সমস্যা নেই। আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আহ্বানে দীর্ঘদিন আলোচনায় বসে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি। এখন সবকিছুর দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি মনে করে তারা আবারও ডাকবে, তখন আমরা বিবেচনা করব।’ আলোচনায় বসতে জামায়াতের আহ্বান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে নতুন কোনো বক্তব্য দেব না।’
সরকারের ভূমিকা ও প্রস্তুতি: দলগুলো সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়ায় চলমান অস্থিরতা কাটাতে অন্তর্বর্তী সরকারকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটি সরকারের পক্ষে এরই মধ্যে জানানো হয়েছে। দলগুলোকে দেওয়া ৭ দিনের সময়সীমা শেষ হলেও সরকার আরও কিছুটা ‘অপেক্ষা করার ইঙ্গিত’ দিয়েছে। তবে দ্রুত দেশের বৃহত্তর কল্যাণে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানানো হয়েছে। গণভোটের তারিখ ও পদ্ধতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সেটি নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আদেশ জারি হতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য নিশ্চিত করা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া চূড়ান্ত করছে। এটি আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উত্থাপন করা হতে পারে।
বিশ্লেষকদের অভিমত: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ বহুল কাঙ্ক্ষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারা সরকারকে দ্রুত বিচক্ষণ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘আমার মনে হয়, ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী দল এনসিপি যেটা চাচ্ছে, সেটাই এখন হওয়া দরকার। যেহেতু বড় দলগুলো বসতে পারছে না একসঙ্গে। ওরা (ছাত্ররা) সরাসরি এখানে জড়িত ছিল। এই ইয়াং জেনারেশনটাই তো বেশি মারা গেছে এবং আহত হয়েছে। তো ওদের দাবির একটা যৌক্তিকতা আছে। আমার মনে হয়, সেদিকেই সরকারের লক্ষ রাখা উচিত। ওদের সঙ্গে কথা বলে ডিসিশন নেওয়া উচিত।’
চলমান সংকটের সমাধান কোন পথে—এমন প্রশ্নে অধ্যাপক দিল রওশন বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন যে বাস্তবতা, এ ধরনের সংকট সমাধানে সরকারকে শক্ত হাতেই হ্যান্ডেল করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ইলেকশনটাকে (সংসদ নির্বাচন) কার্যকর করতে হবে।’ গণভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গণভোট আগে হলে ভালো। পরে হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। পরে যখন ইলেকশন হয়ে যাবে তখন একটা দল চলে আসবে। তখন গণভোট হওয়া না হওয়া দুটিই সমান। এজন্য গণভোট হলে আগেই হতে হবে।’
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে উত্তেজনা একটি গভীর সংকটেরই ইঙ্গিত বহন করছে। সরকার প্রদত্ত আলোচনার সময় শেষ হওয়া এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে অভিন্ন সমঝোতা না হওয়া একটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। যে পরিস্থিতিতে সরকারের হাতে ‘সমস্ত বল’ থাকবে বলে অনেক দল মনে করছে, তা প্রকৃতপক্ষে একটি একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করে। এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান। কারণ, একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বদলীয় সম্মতি বা সর্বাধিক ঐকমত্যই টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি।’
সূত্র: কালবেলা
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ





