• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

সিডরের ১৮ বছর: শুকায়নি ক্ষত, কাটেনি আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক    ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩০ এ.এম.
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের স্মৃতিতে এখনো ডগমগে এক তারিখ ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর সেই রাতে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী শক্তি নিয়ে। উপকূল জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল মৃত্যু, ধ্বংস আর সীমাহীন দুর্ভোগের এক অধ্যায়। ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মনে সেই রাতের বিভীষিকা যেন আজও অমোচনীয়। ঘূর্ণিঝড়ের শব্দ, অন্ধকার, জলোচ্ছ্বাস-সবকিছুই তাদের কাছে এখনো আতঙ্কের অন্য নাম।

হাজারো প্রাণহানি, বিধ্বস্ত জনপদ  
মাত্র আধা ঘণ্টার তাণ্ডবে সিডর লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সমুদ্রতীরবর্তী অসংখ্য জনপদ। বরগুনায় মারা গিয়েছিল ১ হাজার ৩৪৫ জন; বাগেরহাটে প্রাণ হারিয়েছিল আরও ৯০৮ মানুষ। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সবকিছুই যেন মুহূর্তে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জে দেড় লাখের বেশি ঘরবাড়ি ও মৌলিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছিল। বাড়িঘর ভেসে গিয়েছিল, গবাদিপশু মারা গিয়েছিল, কৃষিজমি তলিয়ে গিয়েছিল অনির্ণেয় ক্ষতিতে।

ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে উপকূলবাসীর সবচেয়ে বড় দাবি ছিল-একটি টেকসই ও শক্তিশালী বেরিবাঁধ। বছর গড়িয়েছে, সরকার বদলেছে, প্রকল্প বদলেছে, কিন্তু বেরিবাঁধ নিয়ে মানুষের হতাশা কমেনি। আজ, ১৮ বছর পরও সেই বাঁধ অনেক এলাকায় অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে।

বেরিবাঁধ: মানুষের ভরসা, আবার আতঙ্কও
শরণখোলার বগী, গাবতলা, দক্ষিণখালী, আর মোরেলগঞ্জের আমতলা ও ফাসিয়াতলা এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায় বাঁধের বড় বড় ফাটল, কোথাও ধস, কোথাও সরে গিয়ে নদীতে পড়ে থাকা ব্লক। যে বাঁধ মানুষের জীবন রক্ষা করবে, সেই বাঁধই আজ অনেকের চোখে নতুন আতঙ্কের উৎস।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও বাঁধের প্রকৃত অবস্থা খুব বেশি বদলায়নি। কোথাও সঠিকভাবে ব্লক বসানো হয়নি, কোথাও ভূমি পরীক্ষা ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে। সামান্য জলোচ্ছ্বাসেই বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ে।

একজন বাসিন্দা ক্ষোভ নিয়ে বললেন, “১৮ বছর ধরে শুধু শুনছি-মেরামত হবে, নতুন করে বাঁধ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো আমরা রাত কাটাই আতঙ্কে। ঘুমোতে গেলে মনে হয়-হঠাৎ পানি উঠে এলে কী হবে?”

বাসিন্দাদের মর্মস্পর্শী স্মৃতি: এখনো বুক কাঁপে
শরণখোলার দক্ষিণ সাউথখালীর দেলোয়ার হোসেন এখনো সেই রাতের কথা বলার সময় থমকে যান। চোখ ভিজে ওঠে স্মৃতির বেদনায়। ২০০৭ সালের সেই রাতে তিনি হারিয়েছিলেন তার পাঁচ বছরের ছেলে আর চার মাস বয়সী মেয়েকে।

তিনি বললেন, “সিডরের আগে সরকার কোনো সংকেত দেয়নি। আমরা ভাবছিলাম কিছু হবে না। কিন্তু হঠাৎ এমন স্রোত এল-ঘরের ভেতরেই পানি ঢুকে সব উলটপালট। চোখের সামনে আমার দুই সন্তানকে নিয়ে গেল পানির স্রোত… কিছুই করতে পারিনি।”

তার কথায় বোঝা যায়, সিডরের ক্ষত শুধু শারীরিক নয়-মনেও গভীর দাগ কেটে গেছে। রাতে ঘুমাতে গেলেই এখনো ভয় চেপে ধরে তাকে। মনে হয় আবার যেন পানি উঠে আসে।

২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় রেমাল সেই ভয়কে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। তাদের বাড়ি আবারও ভেসে গেছে; এখন তারা বেরিবাঁধের ওপর ছোট্ট একটি ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন। কিন্তু সেই বাঁধও যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে-এমন পরিস্থিতি।

দেলোয়ারের আকুতি-
“নদীকে ঠিকভাবে শাসন করতে হবে। পানির চাপ না কমলে বাঁচা সম্ভব না। আর খাবার পানির ব্যবস্থা যদি করা যায়-তাহলে মানুষ অন্তত টিকতে পারবে।”

শিশুরা বড় হচ্ছে আতঙ্ক নিয়ে সাউথখালী গ্রামের এক বাসিন্দা জানালেন, বাচ্চাদের স্কুলে মন বসে না। আকাশ কালো হলে বা ঝড়ো হাওয়া বইলে তারা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। অভিভাবকেরাও দুশ্চিন্তায় থাকেন-কারণ বাঁধ ভেঙে গেলে প্রথমেই ডুবে যাবে তাদের স্কুল।

এছাড়া, বরগুনা জেলায় ১২ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৬৭৩টি সাইক্লোন শেল্টার আছে। দুর্যোগের সময় মানুষ কোথায় আশ্রয় নেবে-এই বড় প্রশ্নটি এখনও সমাধান হয়নি। ফলে ঝড়ের আভাস পেলেই নির্ঘুম রাত কাটে পটুয়াখালী-বরগুনার সাধারণ মানুষের।

বিশেষজ্ঞ ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া বাঁধ নির্মাণের কারণেই অল্প জলোচ্ছ্বাসেই তা ভেঙে পড়ে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নুরুল আমিনের মতে, যথাযথ মূল্যায়ন ও আধুনিক প্রকৌশলগত পরিকল্পনা ছাড়া উপকূলীয় সুরক্ষা সম্ভব নয়।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, একাধিক স্থানে হঠাৎ বৃষ্টিতে বাঁধ নরম হয়ে ভেঙে পড়েছে। নদীভাঙন তো আছেই। ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতের জন্য প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, বাকিগুলো দ্রুত শুরু হবে।

এদিকে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম জানিয়েছেন, সিডরে নিহতদের গণকবর সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও বেরিবাঁধ সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

১৮ বছর পরেও প্রশ্ন একই—‘আমরা কোথায় গিয়ে বাঁচব?’
১৯৮৫ থেকে ২০২৫-চার দশক ধরে উপকূলবাসীর জীবনে ঘূর্ণিঝড় মানেই মৃত্যু-আতঙ্ক। কিন্তু ২০০৭ সালের সিডর যে ক্ষত রেখে গেছে, তা ১৮ বছরেও শুকায়নি। ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল হাজারো জীবন। গাছ, ঘরবাড়ি, জমি-সব মুহূর্তে মুছে গিয়েছিল।

তার ওপর নতুন যোগ হয়েছে নদীভাঙন আর অরক্ষিত বেরিবাঁধের ভয়। বছরের পর বছর ধরে মানুষের দাবি-একটা শক্তিশালী, টেকসই, আধুনিক বেরিবাঁধ; পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র; নিরাপদ পানির ব্যবস্থা; নদী শাসনের টেকসই পরিকল্পনা।

মানুষের প্রশ্ন-“সিডরে সব হারালাম। রেমালে আবার হারালাম। বাঁধ যদি ঠিকমতো না থাকে-আমরা কোথায় গিয়ে বাঁচব?” ১৮ বছর পরও এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।

ভিওডি বাংলা/জা

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
দিল্লি যাচ্ছেন খলিলুর রহমান
দিল্লি যাচ্ছেন খলিলুর রহমান
দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নারীদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হবে : সেনাপ্রধান
দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নারীদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হবে : সেনাপ্রধান
বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ
বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ