নতুন ইউনিফর্ম, পুরনো ভয়....

জামশেদ নাজিম
ঢাকার আকাশে সন্ধ্যার আলো নামতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে উঠেছে এক নতুন দৃশ্য— পুলিশের কফি–ধূসর ইউনিফর্ম। সরকার একে ঘোষণা করেছে “নতুন শুরু” এবং “জুলাই-পরবর্তী পরিচ্ছন্ন অধ্যায়” হিসেবে। অথচ এই রঙের প্রথম ঝলকে জনমনে জন্ম নেয়নি আশা; বরং বিরক্তি, হতাশা এবং গভীর অনাস্থা।
আমার বিশ্বাস, এই দেশের মানুষ রঙ বোঝে, রুচি বোঝে, প্রতীক বোঝে। পুলিশ শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়— এটি রাষ্ট্রের মুখ, নিরাপত্তার অবলম্বন। সেই মুখে যখন চাপানো হয় অদ্ভুত, বেমানান, নান্দনিকতাহীন কফি–ধূসর রঙ, তখন এটি কেবল ইউনিফর্মের পরিবর্তন নয়; মনে হয় রাষ্ট্র নিজেই নাগরিককে বলছে— “আমরা সৌন্দর্য জানি না, প্রতীকের মর্যাদাও বুঝি না।”
আমার এমন কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই— স্বাধীনতার পর থেকে কি আমরা শুধু বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করেছি? নাকি মন্দকে সরিয়ে ভালোকে আনতেই নতুন কিছু এনেছি? যদি সত্যিই ভালো কিছু আনার কথা হয়, তাহলে পুলিশের নতুন পোশাক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে, দুটি গভীর আঘাতই দিয়েছে।
প্রথম আঘাতটি হলো ‘আয়রন গ্রে’—একটি মলিন, নিস্তেজ রঙ, যা আমাদের আলো, ধুলো ও আর্দ্র পরিবেশে আরও বিবর্ণ এবং অপরিচ্ছন্ন দেখাবে। এর সঙ্গে কফি রঙের প্যান্ট— দুটি অচেনা ছায়ার জোড়। এখানে কোনো ঐতিহ্য নেই, কোনো গরিমা নেই, কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতীকী ভাষা নেই। যেখানে ইউনিফর্মের কাজ হলো শক্তি, শৃঙ্খলা ও মর্যাদার প্রতীক হওয়া, সেখানে আজ আমরা দেখি কেবল অপ্রস্তুত নকশা।
দ্বিতীয় আঘাত হলো ফ্যাব্রিকের মান। প্রথম দিনেই দেখা গেছে ঘামে ভেজা দাগ, ভাঁজ পড়া কাপড় এবং ঝুলে থাকা প্যান্ট। তাছাড়া বাংলাদেশে আর্দ্রতা প্রায় ৮০ শতাংশ, এবং পুলিশকে রোদ-বৃষ্টি ও দৌড়ঝাঁপে কাজ করতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে নিম্নমানের কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে অদূরদর্শিতা বা ব্যবসায়িক স্বার্থে।
আমার বিশ্বাস, আজ পুলিশের লাখো মুখে নীরব কান্নার সুর বাজছে। তাদের চিৎকারের শক্তি আছে, কিন্তু সদ্য কলঙ্কিত অধ্যায়ের ভারে তারা নীরব। তবে ইতিহাস প্রমাণ করে— পোশাক বদলেছে, কখনোই মনোভাব ও আচরণ বদলায়নি। সেই ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ছিল মূলত উপনিবেশিক শাসনের হাতিয়ার। পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে শক্তি প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আবার পুলিশের নতুন পোশাক, অস্ত্র কিংবা থানা— সবকিছু বদলেছে বারংবার; শুধু বদলায়নি আইন, মানসিকতা, জবাবদিহি। ফলে পুলিশ জনগণের বন্ধু নয়, বরং ভয়ের প্রতীক।
স্বাধীনতার পর প্রথম জনমুখী পুলিশের প্রমথ স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালে পুলিশ কমিশন গঠিত হয়। প্রস্তাব ছিল— ব্রিটিশ আইন বাতিল, নতুন পুলিশ আইন, কমিউনিটি পুলিশিং, মানবাধিকারভিত্তিক প্রশিক্ষণ। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সব প্রস্তাব কাগজেই থেকে যায়।
জনবান্ধব পুলিশ গঠনে দ্বিতীয়বার ১৯৮২ সালে গঠিত পুলিশ রিফর্ম কমিটি প্রস্তাব করে— নিরপেক্ষ পদোন্নতি, আধুনিক প্রশিক্ষণ, নারী পুলিশ বৃদ্ধি। তবে সামরিক শাসনের সময় পুলিশ পরিণত হয় রাজনৈতিক দমনযন্ত্রে। সংস্কারের নামে শুধু পোশাক ও অস্ত্র পরিবর্তন হয়েছে।
গণতন্ত্র ফিরলেও ১৯৯৬–২০০৬ সালের ‘জনমুখী পুলিশিং’ এবং ২০০৪ সালে ইউএনডিপির সহায়তায় শুরু হওয়া পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রাম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়। কিছু মডেল থানা চালু হলেও পদোন্নতি ও বদলি দলীয় স্বার্থে হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্প স্থগিত করে।
২০০৯ সালে আবার পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। প্রস্তাব ছিল—পুলিশ আইন ২০১১-এর খসড়া, স্বাধীন তদন্ত কমিশন, পুলিশের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়। জরুরি সেবা ৯৯৯, অনলাইন জিডি— কিছু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হলেও গুম, ক্রসফায়ার, গায়েবি মামলা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ হয়ে ওঠে ভয়ের প্রতিশব্দ।
জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পর নতুন পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। ১৫ নভেম্বর ২০২৫-এর প্রস্তাব— স্বাধীন পুলিশ কমিশন, পুরোনো আইন বাতিল, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কঠোর শাস্তি, কমিউনিটি পুলিশিং শক্তিশালীকরণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় উন্নত প্রশিক্ষণ। তবে বাস্তব রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখনো অনিশ্চিত।
একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমার অনুভূতি স্পষ্ট— পোশাক বদলানো যায় এক রাতে, কিন্তু হৃদয় বদলাতে লাগে বিপ্লব। আইন বদলাতে লাগে সাহস, জবাবদিহি আনতে লাগে সদিচ্ছা। ইতিহাস প্রমাণ করেছে— স্বার্থের কাছে স্বপ্ন বহুবার পরাজিত হয়েছে, পুলিশকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে কেউ সাহস করেনি।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ভিওডি বাংলা/ এমএম
নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়।
