শেখ হাসিনা
ক্ষমতার চূড়া থেকে ফাঁসির ফেরারি

বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক নেতা এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকেননি। বাংলাদেশে আর কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের মাথার ওপর ঝোলেনি মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া। বাবার উত্তরাধিকারে তিনি উঠে এসেছিলেন শীর্ষ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয়তাকে সঙ্গী করে একসময় পৌঁছান ক্ষমতার চূড়ায়। একসময়ের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নেত্রী, সেই শেখ হাসিনাই স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনে।
টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ শাসনের পর চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে তাকে পালাতে হয়েছে ভারতে। সেই আন্দোলন দমাতে প্রায় ১৪০০ মানুষকে হত্যার ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শেখ হাসিনা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি।
চার মাসের বিচার প্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে, যে আদালত শেখ হাসিনার সরকার গঠন করেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধরীদের বিচারের জন্য।
তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, এটা ‘স্পষ্ট’ যে শেখ হাসিনা ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা এবং নির্মূল’ করতে তার দলের কর্মীদের ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের ভূমিকায় ছিলেন, তাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় জেলে যেতে হয়েছে। তবে আদালতের রায়ে কাউকে ফাঁসির আসামি হতে হয়নি। হত্যার দায় মাথায় নিয়ে কাউকে বিদেশেও পালাতে হয়নি।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনা এর আগে একবারই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন ২০০৭ সালে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়। ওই বছরের ১৬ জুলাই ভোরে ধানমন্ডির বাসা ‘সুধা সদন’ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় চাঁদাবাজির এক মামলায়।
গ্রেপ্তার করেই তাকে সরাসরি আদালতে নেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে নেওয়া হয়েছিল জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষভাবে তৈরি সাবজেলে। প্রায় এগার মাস বন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য।
শেখ হাসিনা জেলে যাওয়ার প্রায় দুই মাস পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও দুর্নীতির মামলায় জেলে যেতে হয়। তাকেও রাখা হয়েছিলো সংসদ ভবন এলাকার আরেকটি সাবজেলে। পরে তিনিও জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা দুজনই অংশ নেন, যে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনের সূচনা হয়। তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন পেরিয়ে ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে।
৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে গত বছর অক্টোবরে ভারতকে চিঠি দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সেই চিঠির কোনো জবাব ভারত সরকার দেয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ষাটের দশকে ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে।
১৯৬৬-৬৭ সালে ছাত্রলীগ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই শেখ হাসিনা তার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বোন শেখ রেহানা ও ছোট ভাই শেখ রাসেলের সঙ্গে ঢাকায় বন্দি ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য যখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে, হাসিনা তখন স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার জার্মানির কর্মসূত্রে বেলজিয়ামে অবস্থান করছিলেন। শেখ রেহানাও তার সঙ্গে ছিলেন।
এরপর দীর্ঘ সময় দেশে ফিরতে পারেননি শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাকে দলীয় প্রধান নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন তিনি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিসহ রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে জয়ী হয়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই দলীয় প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালে অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের কাছে হেরে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেনস শেখ হাসিনা। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট। গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জনের প্রাণ যায়। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই বাধে রাজনৈতিক বিরোধ।
সে সময় বিধান ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি। বিএনপি সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা দুই বছর বাড়ানোর পর কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়কের প্রধান হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে।
কে এম হাসান একসময় ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। এই কারণ দেখিয়ে আওয়ামী লীগ তাকে মেনে না নিয়ে আন্দোলনে যায়। একেবারে শেষ সময়ে কে এম হাসান দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান।
পরে সংবিধানে উল্লেখিত আরও কিছু ধাপ বাদ দিয়ে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন।
এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর বিএনপি সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন সকাল থেকে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের লগি-বৈঠার আন্দোলনে রাজপথে সংঘাত হয়।
এর মধ্যে এক দফা পিছিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি স্থির হয় ভোটের তারিখ। নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট।
ভোটের ১১ দিন আগে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী, প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়েন ইয়াজউদ্দিন। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে শপথ নেয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু ৯০ দিনে ভোটের আয়োজন না করে তারা সময় নেয় প্রায় দুই বছর।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি অর্জন করলেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সঙ্কুচিত হওয়ার অভিযোগ করেন বিরোধীরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে সেই ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়।
এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল।
তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নিশিরাতের নির্বাচন’।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।
প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।
গত বছরের ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়।
অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় ওই রায়ে।
‘জনগণের ভোট ছাড়া’ ওই নির্বাচনগুলো আয়োজনের অভিযোগে গত জুনে একটি মামলা করেছে বিএনপি। ওই তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশনের সব পদাধিকারীর পাশাপাশি ক্ষমতচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে সেখানে।
এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটানা চার মেয়াদের শাসনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে ‘হার্ড পাওয়ার’ হিসেবে বর্ণনা করে টাইম ম্যাগাজিন, আর বিবিসির ভাষায় সেটা ‘ওয়ান উইমেন শো’।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ শাসনে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার দাবি করলেও তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো বলে পরে অভিযোগ ওঠে।
অবকাঠামোখাতে বড় উন্নয়নের নামে দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং সরকার-ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক খাতে লুটপাটের একের পর এক অভিযোগ উঠতে শুরু করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালেই।
ক্ষমতার শেষ দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, তার এক পিয়নই বনে গেছে ৪০০ কোটি টাকার মালিক।
তার শাসনামলে প্রতি বছর অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারের কথা বলা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত একটি টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। পূর্বাচলে ‘প্লট দুর্নীতির’ মামলায় বিচার চলছে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নামা ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের ব্যাপক বলপ্রয়োগের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এখন তিনি দ্বিতীয়বারের মত নির্বাসনে আছেন ভারতে।
শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটি হাই কোর্ট বাতিল করার প্রতিক্রিয়ায়।
১ জুলাই মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের টানা কর্মসূচির মধ্যে সরকারও হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে, ফলে সেই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়।
পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৪ জুলাই। সেদিন চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে–‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’। সেই রাতে ছাত্রলীগ পাল্টা মিছিল বের করে, সেখানে স্লোগান দেওয়া হয়–‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’
পরদিন সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্যের জবাব দেবে ছাত্রলীগ।”
সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের পেটায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়।
সেদিন সংঘর্ষে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে ছাত্রদল নেতাসহ তিনজন, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ছাত্রলীগ কর্মী ও এক হকার এবং রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। রংপুরে পুলিশের বন্দুকের সামনে আবু সাঈদের বুক পেতে দাঁড়ানোর ছবি ছড়িয়ে দেয় দ্রোহের আগুন।
১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা আদালতে ন্যায়বিচার পাবে।
তবে পরের দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ডাক আসে শিক্ষার্থীদের তরফে। সেদিন ঢাকার বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
দুপুরের পর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হতে থাকে। পরের তিনদিন ধরে চলে সংঘর্ষ, প্রাণহানি ঘটে দুই শতাধিক মানুষের।
পরে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কখনো ৮ দফা, কখনো ৯ দফা দাবি জানানো হয়। ঘটনার পরম্পরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবি জানানো হয়।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে সারাদেশে পুলিশসহ শখানেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। জারি করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে ৫ অগাস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সেদিন বেলা ১১টার পর থেকে লাখো জনতা কারফিউ ভেঙে ঢাকার বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে শুরু করে। এরইমধ্যে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন।
কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলনে প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হওয়ার তথ্য এক প্রতিবেদনে দিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। ‘সরকারের উচ্চ পর্যায়ের’ নির্দেশে আন্দোলনকারীদের উপর বলপ্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
শেখ হাসিনার পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে চলা হত্যাযজ্ঞের বিচারের উদ্যোগ নেয়। সেই সময়ের হত্যাকাণ্ডকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বিবেচনা করে বিচার চলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
প্রসিকিউশনে জমা পড়া সাড়ে চারশ অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা হয়েছে, তার মধ্যে চারটিতে অভিযুক্ত করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
এর মধ্যে বিচারকাজ শেষ হওয়া প্রথম মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে আসামি ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তাদের মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হন। তিন আসামির মধ্যে একমাত্র তিনিই কারাগারে আটক আছেন, বাকি দুজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলে।
আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট ৫ অভিযোগ আনা হয় তিন আসামির বিরুদ্ধে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি প্রসিকিউশন টিমও পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পান তাজুল ইসলাম, যিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজা পাওয়া জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে পলাতক দেখিয়ে চলা এই মামলায় আইন অনুযায়ী তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে রাষ্ট্রপক্ষ। তাদের পক্ষে আদালতে লড়েন আইনজীবী আমির হোসেন।
রাজসাক্ষী মামুনের জবানবন্দির পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে আহত, নিহতের পরিবার এবং সম্মুখসারির নেতাসহ ৫৪ জনের সাক্ষ্য আদালতে হাজির করে প্রসিকিউশন। আন্দোলনের সময়ে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ‘নির্দেশের’ বেশ কিছু অডিও কথোপকথন শুনানিতে উপস্থাপন করা হয়।
গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানায়, শেখ হাসিনার মামলার রায় দেওয়া হবে ১৭ নভেম্বর। তখন থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত বোমাবাজি আর গাড়ি পোড়ানো শুরু হয়ে যায়। রায় ঘিরে রবি ও সোমবার কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ।
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত রায় ঘোষণার কার্যক্রম এজলাস থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যার প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য রায়ে শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড।
আর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’, চাঁনখারপুলে ছয় হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।
চাঁনখারপুলে ছয় হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল।
তাদের মধ্যে কামালকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে তথ্য দিয়ে অপরাধ প্রমাণে সহযোগিতা করায় তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ডের লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় এল তার বিয়ে বার্ষিকীর দিনে। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল।
ঢাকায় রায় হওয়ার পরপরই ভারত থেকে বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি শেখ হাসিনা। তার সেই বিবৃতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করে।
এ রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দিয়ে হাসিনা সেখানে বলেন, “আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘৃণ্য আদেশের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের চরমপন্থি ব্যক্তিরা আমাকে হত্যার যে মনোভাব প্রকাশ করছে—বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যই সেখানে স্পষ্ট।”
ভিওডি বাংলা/ এমএম
