জমিতে ১৬ টাকার পাতাকপি রাজশাহীর বাজারে হচ্ছে ৪০ টাকা

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোলাই বিলে এবার প্রচুর পরিমাণে ফুলকপি ও পাতাকপির চাষ হয়েছে। এছাড়াও এ উপজেলার ইশ্রিপুর, মাথাভাঙ্গা, সুশিতলা, পবা উপজেলার দামকুড়া, নওহাটা, পারিলা, বড়গাছী, খড়খড়ি, মোহনপুরের বস্তকেদারপুর, মৌগাছীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিলগুলোতে এবার ফুলকপি ও পাতাকপির চাষ হয়েছে ব্যাপক হারে। এসব বিল থেকে সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে কপি কিনে নিয়ে ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাহারে পাঠাচ্ছেন পাইকাররা। বিলের পাতা কপি চাষকারী কৃষকরা প্রতিপিচ কপি বিক্রি করছেন ১৬ থেকে সাড়ে ১৬ টাকা হিসেবে। কিন্তু সেই কপি রাজশাহীর বাজারে এসে হচ্ছে ৪০ টাকা পিচ।
গোলাই বিল থেকে রাজশাহীর বাজারের দূরুত্ব সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু এই সামান্য পথটুকু পাড়ি দিয়ে শহরে এসেই একেকটি পাতা কপির দাম হয়ে যাচ্ছে ৪০ টাকা করে। ঢাকায় গিয়ে সেটির দাম আরও বাড়ছে। সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা করে।
গোদাগাড়ীর গোলাই বিলে কথা হয় পাতাকপির পাইকারি ব্যবসায়ী শামীম হোসেনের সঙ্গে। দামের এমন আকাশ-পাতাল হেরফের কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘১৬-১৭ টাকা দামে একেকটি কপি জমি থেকে কিনলেও বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত আরও খরচ হবে প্রতিটির পেছনে ৭-৮ টাকা হারে। এরপর সেটি পাইকারি বিক্রি হবে ঢাকার আড়তে। সেখানে পাইকারি বিক্রি হবে ৩০-৩৫ টাকা দামে। এর জন্য আড়তদারকে দিতে হবে ৬ হাজার টাকা কমিশন। আড়ৎ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা আবার কিনে নিয়ে গিয়ে প্রতি পিচ ৫-১০ টাকা করে লাভে বিক্রি করবেন। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে ১৬-১৭ টাকার পাতাকপি ঢাকার বাজারে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা দামে। এমনকি সামান্য ১৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর বাজারে এসেও বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিচ ৪০ টাকা দরে।
শামীম হোসেন আরও জানান, ঢাকায় এক ট্রাক কপি পাঠাতে প্রথমে জমি থেকে ট্রাক পর্যন্ত উঠাতেই প্রতি ট্রাকে খরচ হবে ৬ হাজার টাকা। এরপর ট্রাক ভাড়া লাগবে ১৬-১৭ হাজার টাকা। একেকটি ট্রাকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার পাতাকপি ধরবে। ঢাকায় একজন লোক বসে থেকে সেই কপি বিক্রি করবে। তাকে দিতে হবে এক-দুই হাজার টাকা, এর পর আড়তদারকে কমিশন থেকে ৬-৭ হাজার টাকা। ফলে ১৬ টাকার কপি কিনলেও ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি পিচ গিয়ে ঠেকছে ২৩-২৫ টাকা হারে। আড়তে বিক্রি করে গাড়িপ্রতি ২০ হাজার টাকা যদি তাঁর লাভ হয়, তাহলে সেই সাড়ে ৪ হাজার কপিতে প্রতি পিচে আরও ৪ থেকে ৬ টাকা হারে বৃদ্ধি পাবে। ফলে ১৬ টাকার কপিতে আমার লাভসহ দাম পড়বে ৩০-৩২ টাকা দরে। সেটি আবার খুচরা বিক্রেতারা কিনেত গিয়ে তাদেরকেও খাজনা দিতে হবে। তার পর তারা আবার প্রতি পিচে ৫-১০ টাকা হারে লাভ করবে। সে কারণে ১৬-১৭ টাকার কপি ঢাকার বাজারে গিয়ে হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা করে।
ঢাকার চেয়ে ২৭০ কিলোমিটার কাছে রাজশাহীর বাজারেও তাহলে কেন এতো দাম বেশি হচ্ছে? জানতে চাইলে পবার হরিপুর এলাকার কৃষক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমরা স্থানীয় বাজারে ২০০-২৫০ টা করে কপি নিয়ে যায়। সেখানে এই কপি নিয়ে যেতে গাড়ি ভাড়া দিতে হয় ৭-৮শ টাকা। কপি কাটতে এবং গাড়িতে উঠানো পর্যন্ত দুই-তিনজন শ্রমিকের পেছনে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এর পর হাটে গিয়ে খাজনা দিতে হয় কপি প্রতি এক-দুই টাকা। ফলে রাজশাহীর বাজারে নিয়ে গেলেও একেকটি কপির পেছনে অন্তত ৮-১০ টাকা খরচ হয়। সে কারণে জমিতে পাইকারী বিক্রির হিসেব ধরলে রাজশাহীর বাজারে একেকটি কপি পৌঁছাতে খরচ হচ্ছে ২৪-২৫ টাকা করে। সেটি কিনে নিয়ে গিয়ে রাজশাহীর খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ৫-১০ টাকা বেশি দামে। তাদেরকেও বাজারে কপি কিনতে খাজনা দিতে হয়। এর পর গাড়িভাড়া দিয়ে দোকানে নিয়ে যেতে হয়। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে ১৬-১৭ টাকার পাতাকপি রাজশাহীর বাজারে এসে হচ্ছে ৪০ টাকা করে।
মোহনপুরের কৃষক আজগর আলী জানান, একইভাবে যে ফুলকপি জমিতে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২২-২৫ টাকা কেজি (৮৮০-হাজার টাকা মণ) হিসেবে। সেটি রাজশাহীর বিভিন্ন বাজারে গিয়ে হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা কেজি (১৬ থেকে ১৮শ টাকা মণ) হিসেবে। সেটি রাজশাহীর বাজারে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। এভাবে ফুলকপির দামও আকাশ-পাতাল হেরফের ঘটছে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে এসেই। আবার ঢাকায় গেলে সেই ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি হিসেবে।
যদিও এই ফুলকপিই মাত্র ১৫ দিন আগেও বিক্রি হয়ে ২০-২৫ টাকা কেজি হিসেবে। তবে মাঝে দুইদিনের বৃষ্টির কারণে রাজশাহী অঞ্চলে প্রচুর সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দাম দ্বিগুন হারে বেড়ে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
পবার হরিপুর এলাকার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমরা স্থানীয় বাজারে ২০০-২৫০ পিস বাঁধাকপি নিয়ে যাই। এতে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা গাড়িভাড়া লাগে। কপি কাটা আর গাড়িতে তোলায় শ্রমিক খরচ এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এরপর হাটে গিয়ে খাজনা দিতে হয়। রাজশাহীর বাজারে কপি নিতে নিতে খরচ হচ্ছে ২৪-২৫ টাকা। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে ১৬-১৭ টাকার বাঁধাকপি রাজশাহীর বাজারে এসে হচ্ছে ৪০ টাকা।
ক্ষেতে দাম যা-ই হোক, লাভের মুখ দেখে কৃষকরা খুশি। গোদাগাড়ীর গলায় গ্রামের কৃষক সাব্বির হোসেন বলেন, ‘এবার সাড়ে চার বিঘা জমিতে বাঁধাকপি চাষ করেছি। খরচ হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার টাকার মতো। প্রতিটি বাঁধাকপি বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৬ টাকা দরে। এর মধ্যে আড়াই বিঘা জমি থেকে আড়াই লাখ টাকার বাঁধাকপি বিক্রি হয়েছে। বাকি দুই বিঘায় আরো প্রায় দুই লাখ টাকার বাঁধাকপি বিক্রি হবে বলে আশা করছি। সেই হিসাবে প্রায় তিন লাখ টাকা লাভ থাকবে।’
এদিকে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা জানান, এখন পর্যন্ত রাজশাহীতে ৬৯০ হেক্টর জমিতে ফুলকপি এবং ৪৪২ হেক্টর জমিতে পাতাকপির চাষ হয়েছে। আরও মাস খানেক এই দুটি সবজির চাষ চলবে। যেসব ফুলকপি ও পাতাকপি বাজারে এখন আসছে, সেগুলো একটু আগাম জাতের।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ





