রাজশাহী নগরজুড়ে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য

রাজশাহী নগরজুড়ে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হচ্ছে। ফুটপাত, ভ্যান ও ছোট দোকানে ব্যবসা করে যাঁরা জীবন-জীবিকা চালান- চাঁদাবাজির সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন তারাই। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য থেকে রেহায় পাচ্ছে না কোচিং সেন্টারসহ নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাড়ি বা ভবন নির্মাণ মালিকরাও। একেক এলাকায় একাধিক গ্রুপ এলাকা ভাগাভাগি করে প্রতিদিন চাঁদা তুলছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, পুলিশকে অভিযোগ করার মতো পরিস্থিতি নেই। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে দায়িত্বরত পুলিশের সামনে যখন চাঁদাবাজরা দল বেঁধে আসে। তখন পুলিশ দেখে না দেখার ভান করে। ফলে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকেন; কার পণ্য কখন উল্টে দেওয়া হয়, বলা যায় না। এ অবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে তারা পুলিশ নয় বরং মহানগর বিএনপির নেতাদের কাছে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
নগরীর কাটখালী থেকে কাশিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে প্রতিদিন ৫-৭ হাজার ভ্রাম্যমাণ দোকান বসে। এসব দোকানের বড় অংশে নিয়মিত চাঁদা নেয় বেশকিছু সক্রিয় গ্রুপ।
সাহেববাজার বড় মসজিদসংলগ্ন এক পেয়ারা বিক্রেতা বলেন, আগে দোকানপ্রতি দৈনিক ২০ থেকে ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। তখন নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় এক সাবেক কাউন্সিলরের লোকজন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আরেক সাবেক কাউন্সিলরের ছেলের নেতৃত্বে চারটি নতুন গ্রুপ পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন দৈনিক ১০০ টাকা দিতে হয়। বেচাকেনা যাই হোক- টাকাটা দিতে হবেই; না দিলে পরদিন দোকান তুলে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাপড় পট্টির এক ব্যবসায়ী জানান, জিরোপয়েন্ট থেকে সোনাদিঘি মোড় পর্যন্ত ফুটপাতজুড়ে শত শত দোকান বসানো হয়েছে চাঁদাবাজদের মাধ্যমে। ক্রেতারা ফুটপাতেই কেনাকাটা করায় মূল দোকানগুলোতে ভিড় নেই। অনেকেই লোকসানে দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। মালোপাড়া, সোনাদিঘি মোড় ও সিটি কলেজের সামনে ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদ করতে চাইলে চাঁদাবাজরা বাধা দেয়।
তিনি বলেন, ওই সব চাঁদাবাজির বিষয়টি পুলিশেও জানানো হয়েছে; তবে পুলিশ জানিয়েছে- “নেতাদের সঙ্গে কথা বলুন, আমরা কিছু করতে পারব না।”
নিউমার্কেটের এক বস্ত্র ব্যবসায়ী জানান, রাজনৈতিক দলের একজন নেতার অনুসারীরা তিন ভাগে এলাকা ভাগ করে চাঁদা তোলে। ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে দোকান বসিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হচ্ছে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে জোরপূর্বক ভবন থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ টেনে দেওয়া হচ্ছে, আর এর বিনিময়ে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা।
রেলগেট এলাকায় চাঁদা আদায় আরও ভয়াবহ। বাবু নামের এক ফুটপাত ব্যবসায়ী জানান, কয়েকদিন আগে একদল চাঁদাবাজ তার কাছ থেকে জোর করে ৮০০ টাকা নিয়ে গেছে। খাওয়ানোর পরও চাঁদাবাজরা টাকা নেওয়ার পর চলে যায়।
তেরখাদিয়া কাঁচাবাজার এলাকায় ফুটপাতের এক সবজি ব্যবসায়ী জানান, আগে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ টাকা করে দিতে হতো। কিন্তু বছর খানেক থেকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। এখানকার চাঁদাবাজরা এতোটাই শক্তিশালী যে, সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা এই কাঁচাবাজারের টোল আদায় করতে গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয়।
নগরীর সিরোইল বাস্তুহারাপাড়া এলাকার কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, অতিষ্ঠ হয়ে তারা পুলিশ নয়, মহানগর বিএনপির নেতাদের কাছে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। তবে তাদের নাম বললে অত্যাচার আরও বাড়বে বলে নাম প্রকাশ করতে চাননি।
বিষয়টি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী-২ আসনের দলীয় প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘‘অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা নয়। ফুটপাতের অনেক ব্যবসায়ী তাঁকে চাঁদাবাজির কথা বলেছে। এই চাঁদাবাজির সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।’’
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ডিসি গাজিউর রহমান জানান, ব্যবসায়ীরা পুলিশকে অভিযোগ করছেন না। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে অভিযোগ দিলে নাম গোপন রেখে চাঁদাবাজদের আইনগত বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত জুলাইয়ে রাজশাহী মহানগরের ১২৩ জন চাঁদাবাজের নামের একটি তালিকা প্রকাশ হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই তালিকায় বিএনপি, ছাত্রদল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতাকর্মী, জামায়াতে ইসলামীর ছয়জনের নাম ছিল। আর ‘পতিত আওয়ামী লীগ’ পরিচয়ের ২৫ জন ছাড়াও বাকি ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ থাকলেও তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া হয়নি- তাদের ‘সুবিধাবাদী’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। যারা গত বছরের ৫ আগস্টের দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিএনপি ও জামায়াতে মিশে গিয়ে চাঁদাবাজি করছে।
তবে তালিকা প্রকাশের পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাঁদাবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করছেন রাজশাহীর ব্যবসায়ীরা।
ভিওডি বাংলা/মোঃ রমজান আলী/এম







