• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

শিব নদ হারাচ্ছে প্রাণপ্রবাহ, সংকটে নদীকেন্দ্রিক জনজীবন

রাজশাহী প্রতিনিধি    ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:১৯ পি.এম.
শিব নদ। ছবি: ভিওডি বাংলা

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে একসময় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিব নদ এখন যেন চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অথচ একসময় প্রমত্ত এই নদ ছিল কৃষি, নৌযান চলাচল ও স্থানীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এখন বছরের অধিকাংশ সময় নদের বুকে দেখা যায় পলিমাটির চর, বালু আর কচুরিপানায় ভরা। ফলে এ নদে এখন কমেছে মাছের পরিমাণও। নদে জাল ফেলে এখন ছোট ছোট দেশি মাছই মিলছে বেশি। তার পরেও দেশিজাতের অনেক মাছও হারিয়ে গেছে।

ইতিহাস মতে, স্থানীয়দের ভাষায় শিবনদী হিসেবে পরিচিত হলেও এটি একটি নদ। এ নদটি রাজশাহী জেলা শহর হতে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম কোণে বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত। এটি নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার দক্ষিণের বিলাঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। অতপর প্রায় ৪৫ কিমি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে পবা উপজেলার নওহাটার কাছে বারনই নদীতে মিলিত হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদটি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলা ও মান্দা উপজেলা, দক্ষিণে রাজশাহীর, পবা উপজেলা ও গোদাগাড়ী উপজেলা, পূর্বে মোহনপুর উপজেলা, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও নাচোল উপজেলা এবং রাজশাহীর তানোরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, শিব নদী মহানন্দা নদীর একটি শাখা হিসেবে পরিচিত। অতীতে বর্ষা মৌসুমে নদীটি পানিতে টইটম্বুর থাকত। জেলেরা মাছ ধরতেন, কৃষকেরা সেচের জন্য নদীর পানির ওপর নির্ভর করতেন এবং নৌকায় করে পণ্য পরিবহন হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উজানে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, অবৈধ দখল, পলি জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং নিয়মিত খননের অভাবে শিবনদী আজ মৃতপ্রায়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নদীর অনেক অংশে পানির গভীরতা এতটাই কমে গেছে যে হেঁটে পার হওয়া সম্ভব। কোথাও কোথাও নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে আবাদি জমি, বাঁশঝাড়, বাড়ি-ঘরসহ নানা স্থাপনা। এতে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা সেচের পানি না পেয়ে চাষাবাদেও বিপাকে পড়ছেন।

তানোরের কালিগঞ্জ এলাকার স্থানীয় কৃষক আনছার আলী। তিনি জানান, আগে শিবনদীর পানি দিয়ে ধান, গম, আম ও সবজির চাষ করা হতো। এখন গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে, ফলে উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার আগের মতো জমিতে উর্বরতাও থাকছে না। ফলে ফসলে সার-বিষের ব্যবহার হচ্ছে বেশি।
জেলেদের অভিযোগ, নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় তাঁদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। এখন সারাদিন জাল ফেলেও নদীতে ৫ কেজি মাছও জুটছে না বেশিরভাগ সময়। তবে মাছের দাম এখন বেশি বলে কিছুটা পুষিয়ে নিচ্ছেন জেলেরা। আগের মতো ৫-১০ টাকা কেজি মাছ বিক্রি করতে হলে এখন জেলেদের ভিক্ষা করে খেতে হতো-বললেন জেলে হরিদশ পাল।

গত বৃহস্পতিবার নদীর ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে মাছ ধরছিলেন মাখন আলী নামের এক জেলে। তিনি জানান, ‘আগে দেশি অনেক জাতের মাছ পাওয়া যেত। বিশেষ করে সিং, কৈ, বোয়াল, মাগুর, ট্যাংরা, রুই-কাতলা, মৃগেল পাওয়া যেত উল্লেখযোগ্য হারে। এসব মাছ এখনো পাওয়া যাচ্ছে, তবে তুলনামূলক অনেক কম এবং ছোট আকারের। এখন যা মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে পুঠি, দাড়কি বেশি। অল্পকিছু পিওলিও পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে দেশি ছোট ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সব মাছই কমেছে আগের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।

রাজশাহীর নদী বিশেষজ্ঞ মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘শিব নদ শুধু একটি জলধারা নয়, এটি এই অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্যের অংশ। নদী বাঁচলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক থাকবে, জীববৈচিত্র রক্ষা পাবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিও কমবে। কিন্তু পদ্মার মতো শিবনদীও এখন মৃতপ্রায়। দখলে আর খননের ওভাবে এ নদী তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আগে শিব নদে নিয়মিত লঞ্চ চলাচল করত। আমি দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পর লঞ্চে নিজেই গিয়েছি। ১৯৮২ সালেও রাজশাহীর পবার প্রাচীন নদীবন্দর নওহাটা থেকে প্রতিদিন শিব নদ হয়ে লঞ্চ চলাচল করত। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ছিল।

মাহবুব সিদ্দিকী আরও বলেন, নওগাঁর মান্দা উপজেলার বৈদ্যপুরে ষাটের দশকের শুরুতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় জনগণ একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। এর পর থেকে শিব নদের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাহ বন্ধ হয়ে নদটি এখন ধূঁকছে। তাকে বাঁচাতে হলে ওই বাঁধ অপসারণ করতে হবে। তাহলেও যৌবন ফিরে পাবে ঐতিহ্যবাহী শিব নদ

ভিওডি বাংলা/ মোঃ রমজান আলী/ আ

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
শিবচরে ইসলামি আন্দোলনের গণসংযোগ
মাদারীপুর শিবচরে ইসলামি আন্দোলনের গণসংযোগ
নবাবগঞ্জে বিলীনের পথে প্রাচীন যুগের নিদর্শন
নবাবগঞ্জে বিলীনের পথে প্রাচীন যুগের নিদর্শন
পাঁচ দিনব্যাপী বিএডিসি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন
বাকৃবিতে পাঁচ দিনব্যাপী বিএডিসি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন