নিরাপত্তা নিয়ে তবুও শঙ্কা

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে গণভোটও। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন গতবছরের নভেম্বর মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলছে কমিশন। সব পরিস্থিতি সামলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যয় ব্যক্ত করছে সংস্থাটি। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে তাদের আত্মবিশ্বাসও লক্ষণীয়। তবে নাসির উদ্দিন কমিশনের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তব চিত্র যেন ভিন্ন।
তফসিল ঘোষণার পরদিনই গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। দেশে চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হলেও ১৮ ডিসেম্বর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হাদির মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালায়। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের হাত থেকে রেহাই পায়নি গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও। দেশের প্রথম সারির দুইটি গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট বিক্ষোভকারীদের হামলার শিকার হয়।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই এক অনুষ্ঠানে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, “যতই ভোটের দিন ঘনিয়ে আসবে, আপনারা দেখবেন যে ইনশাআল্লাহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অসুবিধা হবে না। আমরা তো কনফিডেন্ট আছি। ভোট উৎসবমুখর হবে ইনশাআল্লাহ। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা আছে।”
এরপর গতকাল রোববার (২১ ডিসেম্বর) নির্বাচন-পূর্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম ও আচরণবিধি প্রতিপালনসহ নির্বাচনি পরিবেশ বজায় রাখতে তিন বাহিনীর প্রধান এবং পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআই, কোস্টগার্ড, বিজিবি, র্যাব, আনসার ও ভিডিপির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দিনব্যাপী বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন।
বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, “সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করে এমন কোনোও কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না। বাহিনীগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনে যা করা দরকার, তা তারা করবে।“
নির্বাচন কমিশন বরাবরই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল। নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন মনে হচ্ছে জানতে চাইলে পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মনিরা খান বলেন, “আমি তো মনে করি যে নির্বাচন কমিশনের সামনে এখন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন নির্বিঘ্নে করতে হলে তাকে সমস্ত স্টেকহোল্ডার, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল এবং সমস্ত দেশবাসীর সহযোগিতা দরকার। ইসিকে মিডিয়া ফ্রেন্ডলি হওয়ার দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “এই ইলেকশন নিয়ে এখন মিডিয়া ফ্রেন্ডলি বাংলাদেশ না হলে মানুষ সুস্থ বোধ করছে না। আমার মনে হয় ইসির মিডিয়ার সঙ্গে খুব ঘন ঘন বসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গেও বসতে হবে। তাদের যদি সর্বোচ্চ সহযোগিতা না পায়, তাহলে ইসির জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা মুশকিল হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন একে অপরকে দোষ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এখন যার যার নিজের কথা বললেই হয়। আগে কে কী করেছে, কে কোনটা বলেছে—এগুলো একদমই বন্ধ করা উচিত। এটা বন্ধ না করলে নিজেদের ভেতরে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও পুরানো কাহিনি নিয়ে সবাই থাকলে দেশ এগোতে পারবে না। সামনে কি করব সেটা বলতে হবে, সেটাই তো কেউ বলছে না। সবাই পুরানো কথা নিয়ে আছে। তারা যদি নিজেই না বুঝে তবে কে বন্ধ করবে? আর যদি বন্ধ না করে, দেশটা রসাতলে যাবে।”
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, “আমাদের বাংলাদেশে আগে কেয়ারটেকার সরকারের সময়ে আমাদের নির্বাচনগুলো হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে এখন অনেক পিছিয়ে আছি। তফসিলের আগে আগের নির্বাচনে যে অবস্থা ছিল, আমরা সেই অবস্থা এখানে দেখতে পাচ্ছি না। আবার তফসিল ঘোষণার পরে আগে যে পরিস্থিতি থাকতো, তা এখন নেই। মোটামুটি এটা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। এজন্য আমাদের এটাকে মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করতে হবে, কীভাবে এই নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আমরা দেখতে পাচ্ছি নিরাপত্তা সংক্রান্ত। আগে যা আমরা দেখিনি—ইলেকশন অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, পত্রিকা অফিসে হামলা, প্রার্থীদের ওপর হামলা—এগুলো এখন দেখা যাচ্ছে। যা আসলে দরকার তা হলো একটি সিরিয়াস ড্রাইভ, যারা এসব করছে তাদেরকে গ্রেফতার করা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা এবং পুরো দেশকে নিরাপত্তার চাদর দিয়ে ঘিরে ফেলা। যদি আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাই, সেটিই করতে হবে।”
তিনি বলেন, “এই নির্বাচনকে যদি আমরা ভালোভাবে আয়োজন করতে চাই, তাহলে দেশের ৩০০ আসনকে নিবিড় নির্বাচনি নিরাপত্তার পরিকল্পনার মাধ্যমে নিরাপদ করতে হবে। আর অন্যকোনও বিকল্প নেই।”
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। সম্প্রতি দুই সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ–৪ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী রেহা কবির সিগমা এবং আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল–৩ (বাবুগঞ্জ–মুলাদী) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী আসাদুজ্জামান ফুয়াদ নিরাপত্তা চেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কাজী রেহা কবির সিগমা বলেন, “পুলিশ ভীতি সৃষ্টি করছে। আমার কর্মী ও আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই ইসি ও প্রশাসনের কাছে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছি।”
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ হয়েছে তাদের নিয়েই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। চূড়ান্ত হিসাবে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন, নারী ভোটার ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩৪ জন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে ইসি। মোট ভোটকক্ষ নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি, যার মধ্যে নারী ভোটকক্ষ ১ লাখ ২৯ হাজার ৬০২টি এবং পুরুষ ভোটকক্ষ ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩৭টি।
নির্বাচন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ লাখের বেশি সদস্য ভোটে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে আনসার-ভিডিপি সদস্যদের সংখ্যাই হবে সাড়ে ৫ লাখের মত। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৯০ হাজারের বেশি। এছাড়া থাকবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ