যে নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ

মো. জামাল উদ্দিন রুনু
বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রের চেতনাজুড়ে এক ধরনের ক্লান্তি আর সমাজের গভীরে জমে থাকা দীর্ঘ অবদমনজনিত ক্ষোভ—সব মিলিয়ে দেশ যেন নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দিশাহারা হয়ে আছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাস্তবতা এই অনিশ্চয়তাকে আরো প্রকট করে তুলেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় সব প্রভাবশালী নেতাকর্মী জনগণের ঘৃণাসঞ্জাত প্রত্যাখ্যান কাঁধে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
যাঁরা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র দখল করে রেখেছিলেন, তাঁরা আজ জনসমর্থনহীন। তাঁরা আজ জনবিচ্ছিন্ন ও ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো চরিত্র। এই শূন্যতা শুধু ক্ষমতার নয়, এটি আস্থার, নৈতিকতার এবং রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের শূন্যতা। যে নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশএই রাজনৈতিক শূন্যতার ভেতরেই আরেকটি গভীর মানবিক সংকট জাতির মননে ছায়া ফেলেছে।
গণতন্ত্রের প্রতীক, আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া আজ শারীরিকভাবে চরম সংকটাপন্ন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নির্যাতন, কারাবাস, বয়সজনিত জটিলতা ও অসুস্থতা তাঁকে ক্রমেই দুর্বল করে তুলেছে। তাঁর শয্যাশায়ী দেহ যেন বাংলাদেশের রাজনীতিরই প্রতিচ্ছবি—দীর্ঘ সংগ্রামে ক্লান্ত, অথচ পরাজিত নয়। খালেদা জিয়ার এই শারীরিক অবস্থা রাজনীতিকে ছাপিয়ে একটি জাতীয় আবেগে রূপ নিয়েছে।
এখানে দলীয় বিভাজন ক্ষীণ হয়ে আসে। সামনে আসে মানবিকতার প্রশ্ন—একজন মায়ের জীবন, একজন নেত্রীর মর্যাদা, একটি জাতির নৈতিক দায়িত্ব। রাজনৈতিক শূন্যতা ও মানবিক বেদনা—এই দুই সংকট একত্র হয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যেক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। রাষ্ট্র যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে—কে পথ দেখাবে? কে এই বিশৃঙ্খল বাস্তবতায় দিকনির্দেশনা দেবে? এই প্রশ্নের উত্তরে জনমানস ক্রমেই গিয়ে থেমেছে একটি নামের কাছে। সেই নাম—তারেক রহমান।
তারেক রহমান আজ কেবল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নন, তিনি হয়ে উঠেছেন সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তরণের প্রতীক। এই অবস্থান তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাননি। এই অবস্থান তিনি অর্জন করেছেন দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও সময়ের নির্মম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
আগামী ২৫ ডিসেম্বর তাঁর প্রত্যাবর্তন তাই নিছক একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি সময়ের দাবিতে সাড়া দেওয়ার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যে মুহূর্তে তিনি দেশের মাটিতে পা রাখছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই দেশনেত্রী খালেদা জিয়া জীবনের সবচেয়ে সংকটাপন্ন সময় কাটাচ্ছেন।
ব্যক্তিগত বেদনা, পারিবারিক দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি—সবকিছুকে অতিক্রম করে তারেক রহমানের এই ফেরা অনেকের চোখে এক ধরনের নৈতিক কর্তব্য পালন। এই ফেরা যেন ঘোষণা করছে, ব্যক্তিগত দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির দায় কাঁধে নেওয়ার সময় এসেছে।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনে তারেক রহমান কেবল সময় পার করেননি, তিনি সময়কে পর্যবেক্ষণ করেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজের রূপান্তরকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী রাজনীতির দুর্বলতা, গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের অভাব, নেতৃত্বের শূন্যতার মতো যে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা তাঁর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেকটাই প্রশমিত হবে বলে জনগণ বিশ্বাস করে। কারণ ইতিহাস বলে, নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতার দখল নয়, নেতৃত্ব মানে সংকটে উপস্থিত থাকা।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবনের পথ কখনো মসৃণ ছিল না। তৃণমূল থেকে দলকে পুনর্গঠনের প্রয়াস, সংগঠনকে আধুনিক ও কার্যকর কাঠামোতে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা, তরুণ ও শিক্ষিত প্রজন্মকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ—এসবের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে কেবল বক্তৃতার নেতা নয়, বরং সাংগঠনিক চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
গ্রেপ্তার, মামলা, নির্যাতন ও নির্বাসন—এসব দিয়ে তারেক রহমানকে ভেঙে দেওয়ার এক দীর্ঘ চক্রান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সূর্যকে যেমন দমিয়ে রাখা যায় না, তেমনি এসব দমন তাঁকে স্তব্ধ করতে পারেনি, বরং এমন দমন তাঁকে দিয়েছে সময়ের গভীর পাঠ।
এই পাঠেরই রাজনৈতিক ভাষ্য হলো বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা কর্মসূচি। এটি কোনো তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নয়, এটি একটি রাষ্ট্রদর্শন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক জবাবদিহি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং যুবসমাজের ক্ষমতায়ন—এই দফাগুলো একত্রে একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রূপরেখা নির্মাণ করে।
দীর্ঘদিনের একমুখিন শাসনব্যবস্থায় যে প্রশ্নগুলো অবদমিত ছিল, ৩১ দফা সেই প্রশ্নগুলোকেই প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা দিয়েছে। এই ৩১ দফার মধ্য দিয়ে তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যে গড়া। এ দেশ সংকটে নায়ক খোঁজে। কিন্তু এই নায়ক কেবল শক্তিমান শাসক নন, তিনি হবেন ভারসাম্যের রূপকার, সহনশীলতার ধারক, পুনর্গঠনের স্থপতি। আজ যখন রাজনীতির নদীতে স্রোত এলোমেলো, মাঝনদীতে চর জেগে উঠেছে, দিগন্ত অস্পষ্ট—মানুষ তখন এমন একজন কাণ্ডারির দিকেই তাকায়, যিনি ঝড় দেখেছেন, অথচ হাল ছাড়েননি।
গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শহরের পাঠাগার, প্রবাসী আড্ডা থেকে সামাজিক আলাপ—সবখানে এখন শুধু একটিই প্রতীক্ষা। কখন আসবেন তিনি, কবে আসবেন তিনি।
আসলে এটি নিছক দলীয় আবেগ নয়, এটি স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা। এটি ভবিষ্যতের প্রতি এক অন্তর্লীন আশা। মানুষ বলছে, এই অন্ধকার সময়ে প্রয়োজন এমন এক নেতৃত্ব, যে প্রতিশোধের রাজনীতি নয়, বরং পুনর্মিলন ও পুনর্গঠনের ভাষা বলবে।
তবে দেশ আজ একটি প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে হাঁটছে। এই প্রস্তুতি কোনো উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা নয়, আবার নিছক রাজনৈতিক কর্মসূচিও নয়—এ এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরিণত আবেগ।
২৫ ডিসেম্বর সকালে যখন তারেক রহমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটিতে পা রাখবেন, তখন সেটি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হবে না, হবে গোটা জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। এক অনিশ্চিত সময়ের মধ্যেও স্থিতি খোঁজার আকাঙ্ক্ষা এর মধ্য দিয়ে ফিরে আসবে।
এই প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখতে যে আয়োজন চলছে, তা আসলে একটি জাতির সম্মিলিত অনুভবের বহিঃপ্রকাশ। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে শহরের রাজপথ, হাসপাতালের প্রান্ত থেকে গুলশানের নীরব অলিগলি—সবখানেই যেন এক অদৃশ্য স্রোত প্রস্তুত হচ্ছে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনার আয়োজন করলেও বাস্তবে এই প্রস্তুতির বিস্তার দলীয় সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।
সারা দেশ থেকে মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার প্রস্তুতি, সামাজিক মাধ্যমে উচ্ছ্বাস, বহুদিনের হতাশা কাটিয়ে ওঠা নেতাকর্মীদের চোখে নতুন প্রত্যয়—সব মিলিয়ে দেশ যেন নিজের ভেতরেই একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তকে ধারণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই সাদর সম্ভাষণ কেবল ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ নয়, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক স্বস্তির নিঃশ্বাস। দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন সেই শূন্যতাকে দৃশ্যমানভাবে পূরণ করছে। তাঁর জন্য যে জনস্রোত প্রস্তুত হচ্ছে, তা ক্ষমতার প্রদর্শন নয়, বরং আস্থার ঘোষণা। মানুষ যেন বলতে চাইছে, আমরা আবার বিশ্বাস করতে চাই, আমরা আবার রাজনীতিকে ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত দেখতে চাই। মায়ের অসুস্থতা, দলের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের অস্থিরতা—সবকিছুকে অতিক্রম করে তাঁর দেশে ফেরা তাই উৎসবের চেয়েও গভীর অর্থ বহন করে।
দেশ প্রস্তুত হচ্ছে তাঁকে বরণ করতে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, দেশ প্রস্তুত হচ্ছে একটি নতুন অধ্যায়ের জন্য। এই প্রস্তুতি নিছক আলোকসজ্জা বা স্লোগানের নয়, এটি আশা, প্রত্যাশা ও দায়িত্ববোধের এক সম্মিলিত প্রস্তুতি।
বাংলাদেশ আজ যে নেতৃত্বের প্রতীক্ষায়, তা কোনো ক্ষণস্থায়ী মোহ নয়, এটি একটি জাতির ক্লান্ত আত্মার দীর্ঘশ্বাস, একটি রাষ্ট্রের নতুন করে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে সেই প্রতীক্ষার কেন্দ্রে আজ একটি নামই ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে—তারেক রহমান।
লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)
ভিওডি বাংলা/ এম
নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়।


