তারেক রহমানকে মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে

মতিউর রহমান চৌধুরী
বাংলাদেশের অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হতে চলেছে, দেশটি যখন উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছে ঠিক তখনই দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ১৭ বছর বিদেশে থাকার পর তার দেশে ফেরা নিয়ে বিস্তর কৌতূহল। সম্ভাবনাময় এক নতুন রাজনীতির ইঙ্গিত আছে। বলা যায়, ভবিষ্যৎ রাজনীতির এক উজ্জ্বল পথিক। আপসের চোরাবালিতে যিনি নিজেকে সমর্পণ করেননি। বন্দুকের নলের মুখে বিলিয়ে দেননি। পরিণতিতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। প্রায় ১৬ বছর নিষিদ্ধ ছিলেন মিডিয়ায়। বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার মুহূর্তে তার হাতে আসে দলটির নেতৃত্ব। বিদেশে বসে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলকে করেছেন সংগঠিত। ৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পর তিনিই রাজনীতিতে নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হন। গত ১৬ মাসে প্রায় সাত হাজার বক্তৃতা করেছেন লন্ডনে এবং বাংলাদেশে। রাজনীতিকরা বক্তৃতার মঞ্চে উঠেই যেখানে ফাউল করেন তারেক রহমান তার ব্যতিক্রম। খুব কম বক্তৃতায় তিনি হয়েছেন সমালোচিত। বরং বেশিই পেয়েছেন প্রশংসা। বিপদটা অবশ্য এখানেই। এক সেনা পরিবারে তার জন্ম। রাজনীতি তখন বাসার চার দেয়ালে পৌঁছাতো না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর বাসায় প্রবেশ করে রাজনীতি।
তবে ছেলেরা এর বাইরে। মা বেগম খালেদা জিয়া আরও দূরে। ’৮১ সনে জিয়াউর রহমান এক সেনা বিদ্রোহে নিহত হওয়ার পর বেগম জিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির হাল ধরেন। এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। নিশ্চিত করেছিলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বেগম জিয়া রাজনীতির ময়দানে নবীন হলেও আপসহীন নেতৃত্বের কারণে চলে আসেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই শুরু করেন। তথাকথিত নির্বাচন তাকে স্পর্শ করেনি। যেখানে শেখ হাসিনা বারবার আপস করে নির্বাচনে যান। ’৯০-এর অভ্যুত্থানে অবশ্য দুই নেত্রীর ভূমিকা ইতিহাসের একটি অংশ। ফলশ্রুতিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিদায় নেন। ঘটনাবহুল নির্বাচনে বেগম জিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে জয় ছিনিয়ে নেন। হন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এরপর আরও দু’বার। হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখেন। তাকে কারাগারে নেয়া হয়। এখন তিনি হাসপাতালে লড়ছেন জটিল অসুখের সঙ্গে। দলমত নির্বিশেষে সবাই তার জন্য প্রার্থনা করছেন। এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা। তারেক রহমান পাশ্চাত্য রাজনীতি দেখেছেন কাছ থেকে। জেনেছেন এক নতুন রাজনৈতিক কালচার সম্পর্কে। যেখানে সরকার বা বিরোধী দলের নেতারা এক সঙ্গে বসে সংসদে লড়াই করেন। আবার এক টেবিলে বসে কফি খান, আড্ডায় মেতে উঠেন। বাংলাদেশে আমরা এর বিপরীতটাই দেখতে পাই। ক্ষমতার পর্দায় সবকিছু ঢেকে যায়। বাংলাদেশ এখন অনেকটা নেতৃত্বশূন্য। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এখন দিল্লির মেহমান। জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতালে। এই সুযোগে উল্টো স্রোতের কাফেলা ভারী হচ্ছে। এই সময়ে আসছেন তারেক রহমান। নতুন এক স্বপ্ন, এক আশা নিয়ে। মানুষ তাকে গত ১৬ মাসে দেখেছে টেলিভিশনের পর্দায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখন দেখবে ময়দানে, বাস্তব এক তারেক রহমানকে। অনেক চ্যালেঞ্জ তার সামনে। দলের ভেতরে বহু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। মনোনয়ন নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা। কেউ কাউকে মানছে না।
তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে অকার্যকর। তবে এটা মানতেই হবে তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে দলটি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। শেখ হাসিনা শত চেষ্টা করেও দলটি ভাঙতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। তারেক রহমান দেশে ফিরে কী দেখবেন। অগণিত মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছে। এই মানুষগুলো তার শক্তি, সাহস। আবার বিপদও। এদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করাটাই হচ্ছে তার প্রথম চ্যালেঞ্জ। ৫ই আগস্টের পর দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে নানা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হন এদের ব্যাপারে তাকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। ওরা সুযোগ সন্ধানী। দল নয়, নিজের ভাগ্য গড়তে চায়। সব সিদ্ধান্ত সঠিক হবে তা ভাববার কোনো কারণ নেই। তবে দলের স্বার্থে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে। ফজলুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়ে উদারতা দেখিয়েছেন। অন্যদের বেলায় ভিন্ন সিদ্ধান্ত কেন? বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে কানকথা শোনা। নেতারা অনেক ভুল করেন কানকথা শুনে। এই মুহূর্তে দেশে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপত্তা। মানুষ নিরাপত্তা চায়। শান্তিতে বসবাস করতে চায়। মুক্তি চায় মব-ভায়োলেন্স থেকে। তারেক রহমানকে এই বিষয়টির প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা সংকট ডালপালা মেলেছে। এই সুযোগে একটি শক্তি দেশকে উল্টো পথে নিয়ে যাওয়ার বিরামহীন চেষ্টা করছে। ভোটারদের মধ্যে স্বস্তি নেই। আক্রান্ত হচ্ছে মিডিয়া। ট্যাগ লাগিয়ে কণ্ঠরোধের চেষ্টা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্ষেত্রে এগিয়ে। তারেক রহমানকে মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
আজকালকের যুগে তথ্য মন্ত্রণালয় রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর খুব কম দেশেই তথ্য মন্ত্রণালয় রয়েছে। যে দেশে তিনি ১৭ বছর থাকলেন সেখানেও নেই। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, তথ্য মন্ত্রণালয় অনুগত মিডিয়া কর্মীদের একটি কারখানায় পরিণত হয়েছে। যার মূল্য দিতে হচ্ছে গোটা সাংবাদিক সমাজকে। তাই আমার মনে হয়, তথ্য মন্ত্রণালয় না রেখে বরং একটি রাজনৈতিক মন্ত্রণালয় রাখা দরকার। যেখানে ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে গবেষণা হবে। যেটা হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক ধারণা। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান একদলের। ভিন্নমতাদর্শীরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের অভাব অভিযোগ জানাতে পারেন না। এর ফলে জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ে। রাজনৈতিক আন্দোলন তখন দানা বাঁধতে থাকে।
রাজনৈতিক মন্ত্রণালয় হলে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি জানতে পারবেন কোথায় কী ঘটছে। এখানে গোয়েন্দা রিপোর্ট মুখ্য হবে না। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে তারেক রহমানকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। মানবাধিকার কমিশন নয়, মানবাধিকার ইনস্টিটিউট গড়তে হবে। যে প্রতিষ্ঠানটির কাজ হবে সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট করা। যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তার মিডিয়া নীতি কী হবে তা এখনই বলা দরকার। হাসিনা ক্ষমতায় গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন। অবশ্য এক অনুগত মিডিয়া তার পাশে ছিল। এটা কোনো কাজেই আসেনি বরং কলঙ্কিত হয়েছে। ১৬ বছরে মাত্র দুইবার হাসিনা সম্পাদকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর ইউনূস ১৬ মাসে একবার দেশি মিডিয়ার সামনে আসেন। তিনি অবশ্য বিদেশি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে পছন্দ করেন। এই বিষয়টিও তারেক রহমানের বিবেচনায় থাকতে হবে। প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হবে। মানুষ চায় আইনের শাসন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাকে হতে হবে কৌশলী। পাশের বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া রেখে নিজের ঘর গোছানো সম্ভব নয়। সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এই মুহূর্তে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটেছে। এই অবস্থায় করণীয় কী হবে তাও মানুষ জানতে চায়।
৫৪ বছরের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নামে বিভক্তি স্পষ্ট। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সংখ্যালঘুদেরকে এই বার্তা দিতে হবে, তারা এদেশের নাগরিক, সমান মর্যাদা-সমান অধিকার। সংখ্যালঘু বলতে আর কিছু নেই। ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করার সুযোগ নেই- এই বার্তাও থাকতে হবে। জনমানুষের প্রত্যাশা এটাই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। দেশি কিংবা বিদেশি কোনো বিনিয়োগই নেই। নিরাপত্তার অভাবে কেউ বিনিয়োগ করতে আসছে না। রয়েছে দখলের ভয়। বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। ফেরানোর উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। শেষ কথা, মানুষ চায় একদিন নয়, তিন শ’ পঁয়ষট্টি দিনের গণতন্ত্র। যাই হোক, ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। তিনি কি শুকতারা হয়ে উঠতে পারবেন? শুধু বিএনপি’র নয়, বাংলাদেশের জাতীয় নেতা হয়ে উঠতে পারবেন? এই চ্যালেঞ্জগুলোই তার সামনে। অতীতের ভুল শুধরে তারেকের অপ্রতিহত জয়যাত্রা হোক-এটাই জনপ্রত্যাশা।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক মানব জমিন
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ/এমএম
নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়।


