‘রক্তের ঋণ শোধের সময় এসেছে’: তারেক রহমান

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণআন্দোলন-দু’টি সময়ের শহীদের রক্তের ধারাবাহিকতাকে এক সুতোয় গেঁথে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনা দিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সব ধর্ম-শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করার একমাত্র পথ হলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকায় বিএনপি আয়োজিত গণ সংবর্ধনা মঞ্চে তিনি এসব কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, আমরা দেখেছি ১৯৭১-২০২৪ সাল পর্যন্ত এই দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তেমনি এদেশের ছাত্র জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ কৃষক, শ্রমিক, গৃহবধূ, নারী-পুরুষ ও মাদ্রাসার ছাত্রসহ দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ সেদিন ২৪ সালের ৫ আগস্ট এই দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল।

বাংলাদেশের মানুষ আজ তাদের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধার করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ চায় তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার পাবে বলে তিনি জানান।
এখন সময় এসেছে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার। এই দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছে, একইভাবে সমতল মানুষ আছে। এই দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে।
একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা চাই সকলে মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলবো আমরা যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন। অর্থাৎ একটি নিরাপদ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলাদেশে নারী-পুরুষ-শিশু যেই হোক না কেন নিরাপদে ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে ইনশাআল্লাহ ঘরে আবার ফিরে আসতে পারে।’
তিনি দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কথা তুলে ধরে বলেন, এই দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, ৪ কোটিরও বেশি তরুণ প্রজন্মের সদস্য, পাঁচ কোটির মত শিশু, ৪০ লাখের মত প্রতিবন্ধী ও কয়েক কোটি কৃষক শ্রমিক রয়েছেন। রাষ্ট্রের কাছে এসব মানুষের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তারেক রহমান বলেন, আমরা সকলে যদি ঐক্যবদ্ধ-প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই তাহলে এই লক্ষ কোটি মানুষের সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
১৯৭১ ও সাম্প্রতিক আন্দোলনের শহীদদের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ’৭১ সালে আমাদের শহীদরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এইরকম একটি বাংলাদেশ গঠনের জন্য। বিগত ১৫ বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শতশত মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় নিরিহ মানুষও প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার ও জীবন দিয়েছে।
২০২৪ সালের আন্দোলনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেদিনের ঘটনায় দেখেছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা কিভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের এই স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য।

সম্প্রতি নিহত ওসমান হাদির প্রসঙ্গ টেনে তারেক রহমান বলেন, কয়েকদিন আগে ’২৪-এর আন্দোলনের এই প্রজন্মের এক সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ওসমান হাদি চেয়েছিল এই দেশের মানুষের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে পাক।
সব শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ’২৪-এর আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, ওসমান হাদিসসহ ’৭১-এ যারা শহীদ হয়েছেন ও বিগত স্বৈরাচারের সময় যারা বিভিন্নভাবে মবের শিকার হয়েছেন। এই মানুষগুলোর রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য আসুন আমরা আমাদের সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ করে বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
বিভিন্ন আধিপত্যবাদ শক্তির ভক্তচরেরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, আমাদেরকে ধৈর্যশীল হতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের যে সদস্যরা রয়েছেন, আপনারাই আগামী দিন দেশকে নেতৃত্ব দিবেন, দেশকে গড়ে তুলবেন, এই দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের সদস্যদেরকে গ্রহণ করতে হবে। দেশকে শক্ত ভিত্তির উপর, গণতান্ত্রিক ভিত্তি শক্তিশালী ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরে গড়ে তুলতে হবে।
এ সময় মঞ্চে এবং বাইরে উপস্থিত জাতীয় নেতৃবৃন্দের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার সাথে বহু জাতীয় নেতৃবৃন্দ বসে আছেন। দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করি আমরা সকলে মিলে এই দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত সেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। দেশের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
দেশের শান্তি রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমাদেরকে যেকোনো মূল্যে এই দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। যে কোন উস্কানির মুখে আমাদেরকে ধীর-শান্ত থাকতে হবে।
তিনি বারবার শান্তির আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রিয় ভাই বোনেরা আমরা দেশের শান্তি চাই। আমরা দেশের শান্তি চাই। আমরা দেশের শান্তি চাই।
এ বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, মার্টিন লুথার কিং-এর নাম শুনেছেন না আপনারা? তার একটি বিখ্যাত ডায়লগ আছে। আজ এই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকলের সামনে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন সদস্য হিসাবে বলতে চাই আই হিপ অফ মাই কান্ট্রি মাই কান্ট্রি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের মানুষের স্বার্থে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য। এই পরিকল্পনা দেশের মানুষ- উন্নয়নের স্বার্থে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন জন্য যদি সেই প্ল্যান, সেই কার্যক্রম ও সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে এই জনসমুদ্রে যত মানুষ উপস্থিত আছেন, সারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শক্তি যত মানুষ উপস্থিত আছেন, প্রত্যেকটি মানুষের সহযোগিতা আমার লাগবে। আপনারা যদি আমাদের পাশে থাকেন, আপনারা যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করেন, ইনশাআল্লাহ আমরা আই হ্যাভ এ প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।

দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় দোয়ার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আসুন আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করি। হে রাব্বুল আলামিন, হে একমাত্র মালিক, হে একমাত্র পরওয়ারদিগার, হে একমাত্র রহমত দানকারী, একমাত্র সাহায্যকারী ও আজ আপনি যদি আমাদেরকে রহমত দেন তাহলে আমরা এই দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম করার মাধ্যমে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারবো।
যদি আল্লাহর রহমত এই দেশ এবং এই দেশের মানুষের উপর থাকে, আল্লাহর সাহায্য দয়া এই দেশের মানুষের উপরে থাকে ইনশাআল্লাহ আমরা আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
তারেক রহমান বলেন, প্রিয় ভাই বোনেরা আসুন আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি ইনশাআল্লাহ আগামী দিনে যে দায়িত্বে আসবে আমরা সকলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওসাল্লামের যে ন্যায় পরণতার আলোকে আমরা দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
বক্তব্যে নিজের মায়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আপনারা জানেন এখান থেকে আমি আমার মা খালেদা জিয়ার কাছে যাব। এ একটি মানুষ যে মানুষটি এই দেশের মাটি ও এই দেশের মানুষকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছেন। তার সাথে কি হয়েছে আপনারা প্রত্যেকটি মানুষ সে সম্পর্কে অবগত আছেন। সন্তান হিসাবে আপনাদের কাছে আমি চাইবো আজ আল্লাহর দরবারে আপনার দোয়া করবেন যাতে আল্লাহ উনার তৌফিক দেন উনি যাতে সুস্থ হতে পারেন।
নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, প্রিয় ভাই বোনেরা, সন্তান হিসেবে আমার মন আমার মায়ের বিছানার পাশে পড়ে আছে সেই হাসপাতালের ঘরে। কিন্তু সেই মানুষটি যাদের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছে অর্থাৎ আপনারা জন্য আমি কোনভাবেই ফেলে যেতে পারি না।
এ কারণে হাসপাতাল যাওয়ার আগে জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, সেজন্যই হাসপাতালে যাবার আগে আপনাদের প্রতিসহ টেলিভিশনগুলোর মাধ্যমে যারা সমগ্র বাংলাদেশে আমাকে দেখছেন আপনাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আজ আমি এখানে দাঁড়িয়েছি আপনাদের সামনে।
দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, প্রিয় ভাই বোনেরা আমাদেরকে আজকে নিশ্চিত করতে হবে আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, আমরা যে দলেরই রাজনৈতিক সদস্য হই, অথবা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হই। আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে কোন মূল্যে আমরা আমাদের এই দেশের শান্তি শৃঙ্খলাকে ধরে রাখতে হবে যে কোন মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে।

সব মানুষের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন,যে কোন মূল্যে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে, শিশু হোক, নারী হোক ও পুরুষ হোক। যেকোন বয়স যেকোন শ্রেণির, যেকোন পেশা, যেকোন ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকে এই হোক আমাদের চাওয়া।
শেষাংশে ঐক্য ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ডাক দিয়ে তারেক রহমান বলেন, প্রিয় ভাই বোনেরা আসুন সবাই মিলে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, সবাই মিলে করবো, কাজ ধরে আনব ও সবাই মিলে কাজ করলে আমাদের বাংলাদেশ আবার শান্তি-শৃঙ্খলায় ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।
বক্তব্য শেষ করার আগে তিনি আবারও দেশের শান্তি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনাদের সকলের কাছে দোয়া চেয়ে, আবারও সকলকে যে কোন মূল্যে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ও যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিহার করে ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করার আহ্বান জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
আবারও আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমাকে এভাবে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
ভিওডি বাংলা-সবুজ/জা



