ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক
তারেক রহমানকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে

১৮ মাস কারাগারে এবং ১৭ বছর বিদেশে কাটানোর পর সশরীরে আবার বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে তারেক রহমান। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে, দুর্নীতির অভিযোগে আটক হয়েছিলেন তিনি। আঠারো মাস কারাগারে থাকার পর, ২০০৮ সালে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্যে চলে গিয়েছিলেন তারেক রহমান।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে গত দেড় বছর ধরেই তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে মা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সংকটাপন্ন অবস্থায় তার দেশে না ফেরার সমালোচনা কম হয়নি। অবশেষে দেশে এলেন তিনি বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) এবং এমন একটা সময়ে ফিরলেন যখন নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে ব্যস্ততা চলছে।
বিদেশে থাকা তারেক রহমানের জন্য তার দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে উদগ্রীব অপেক্ষা ছিল, সেটা তার ঢাকার ফেরার দিনে বিমানবন্দরের আশপাশে এবং পূর্বাচলের ৩০০ ফিটে দল আয়োজিত সংবর্ধনাস্থলে বিপুল মানুষের সমাগম থেকে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ
তারেক রহমানের নিরাপত্তার শঙ্কা অনেকবারই সামনে এসেছে। এবার তিনি ঢাকায় ফেরার পর বিমানবন্দর থেকেই সেনাবাহিনী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা গেছে তার গাড়িবহর ও চলাচলের রাস্তা ধরে। দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তারেক রহমানের বিশেষ নিরাপত্তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে জনসংযোগের ক্ষেত্রে এমন কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিবন্ধকতাও হতে পারে।
দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে খাপ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জও আছে। আবার, তিনি দেশে ফিরে এলেও এখনো তার পাসপোর্টসহ কিছু বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেনের মতে, "জনসাধারণের অনেক প্রশ্ন আছে, তার নেতাকর্মীদের অনেক প্রশ্ন আছে। তিনি কেন এতদিন আসেননি, ওখানে (লন্ডনে) কোন স্ট্যাটাসে থাকলেন, কেন মায়ের (খালেদা জিয়া) অসুস্থতার সময়ও আসতে পারলেন না, আবার এও বললেন তিনি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না এবং সেকথা বলতেও পারছেন না, এগুলো নিয়ে যে অস্বচ্ছতা আছে তার সম্পর্কে, সেটা কিন্তু নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা"।
এছাড়াও আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে, সেটি লন্ডনে তার আয়ের উৎস। এর কোনো সঠিক উত্তর এখনো নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি এতদিন বিদেশে থাকার পর ট্রাভেল পাস নিয়ে যে আসছেন, এরপর তার লন্ডন ফেরার সুযোগ রয়েছে কি না, অথবা তিনি কি যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট নিয়েছেন কি না।
এক্ষেত্রে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তিনি যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন সেটিকে নাগরিকত্বের দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় এবং বাংলাদেশের ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে সে আশ্রয় শেষ হয়ে যাবে।
"এই বিষয়ে ধোঁয়াশা থাকা ঠিক না, আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি তিনি কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন নাই, পাসপোর্ট নেন নাই," বিবিসি বাংলাকে তারেক রহমান আসার আগে বলছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
এখন নিরাপত্তা সংকট বা অন্য কারণে তিনি ফিরে যাবেন কি না এর উত্তরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, "ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন আসবে কেন? তার যদি বিদেশ সফর যাওয়ার প্রশ্ন আসে, ব্যক্তিগত কারণে হোক, অন্য কারণে হোক, বা রাজনৈতিক কারণে হোক, তিনি বিদেশ সফরে যাবেন। সেটা যুক্তরাজ্যেও হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রেও হতে পারে"।
"ফেরত যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন? ফেরত উনি আসছেন, ফেরত যাচ্ছেন না" উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে, ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনামলে তারেক রহমানকে ঘিরে অতীত অভিযোগের প্রেক্ষিতে জনগণের কাছে ভাবমূর্তি পরিবর্তন ও আস্থা ফেরানোর চ্যালেঞ্জও আছে।
যেমন অক্টোবর মাসে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বলেছিলেন, "মানুষ বিএনপির শাসনামলটাকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষের কাছে কিন্তু মোটামুটি তারেক জিয়ার মেমোরিটা এখনো আছে।"
"ওই যে মেমোরিটা, হাওয়া ভবনের যে মেমোরি, মানে বিএনপির বিজয় তাকে কেন্দ্র করেই হবে, এরকমটা যদি বিএনপি চিন্তা করে তাহলে তাকে ও লিগ্যাসি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।"
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীম রেজার মতে, তারেক রহমানের দেশে ব্যক্তিগত দিকের সেসব আলোচনা রয়েছে, সেগুলো খুব একটা জোরালো হবে না। বরং একটা সমবেদনার জায়গা তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় দীর্ঘদিন তারেক রহমান দলটির নেতৃত্ব দিলেও এখন নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তার সামনে রয়েছে। শীর্ষ নেতা হিসেবে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে কৌশল নির্ধারণ বা অনিশ্চয়তা মোকাবিলা ছাড়াও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, বিরোধী পক্ষের সমালোচনা বা চাপ, কূটনৈতিক পর্যায়ে অবস্থান, সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ শক্ত করা- এমন বিভিন্ন বিষয় থাকবে।
২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে গত দেড় বছরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও চাঁদাবাজির বিষয় নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে বেশ অনেক সময়েই।আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ২৫৯টি ঘটনায় ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই হাজার ৯২৩ জন। সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে নিজের একটি ফেসবুক পোস্টে তারেক রহমান বলেছিলেন, বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে সাত হাজারের বেশি দলীয় সদস্যের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
"দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অসদাচরণের দায়ে কেউ পদচ্যুত হয়েছেন; আবার অনেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন। বহুমুখী অপপ্রচারের মাঝেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না, তবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এগুলো ছিল অপরিহার্য"- তারেক রহমানের পোস্টের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়।
মাঠপর্যায়ে সেসব বিষয় মোকাবিলা করে যে 'ঐক্যের' কথা তিনি বলেন সেগুলো দৃশ্যমান করতে হবে তারেক রহমানকে।
অবশ্য বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের মতে, চাঁদাবাজির বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনানুগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা, বিগত সরকারের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্তদের কর্মকাণ্ড, বিরোধী পক্ষের অপপ্রচার এমন বিষয় থাকতে পারে।
একই সাথে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত অনেককে দলে ফেরত নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, "কোনো কোনো সময় মাইনর (লঘু) কিছু কিছু অভিযোগের কারণে আমরা অনেক সময় অ্যাকশন নিয়েছি। সেখানে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়টা তারা ক্ষমা চেয়ে দলের কাছে একটা সময় অব্যাহতি পেতে পারে। কিন্তু গুরুতর কোনো অপরাধের সাথে জড়িত বা ব্যাপক কোনো অনাচারের সাথে জড়িত কেউ যদি ক্ষমা পেয়ে থাকে, সেটা আপনারা নজরে আনতে পারেন"।
"আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তো আমাদের হাতে নেই, যখন থাকবে তখন আমাদেরকে দোষারোপ করা যাবে," বলছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
দলীয় বিভিন্ন সমস্যা, চাঁদাবাজি ইস্যু, এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সেসব সমস্যা বড় করে প্রচার করাটাও তারেক রহমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হবে উল্লেখ করেন বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন।
নেতাকর্মীদের সামাল দেওয়া
আবার নির্বাচনের মাঠে লন্ডন থেকে ফেরা তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মী ও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা, বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পেতে প্রভাব বিস্তার করতে চাওয়া নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে। এর মধ্যেই আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা যতটা ভোগান্তির মধ্য দিয়ে গেছেন, সেসব নেতাকর্মী নির্বাচনী মনোনয়নে জায়গা না পাওয়ার অভিযোগও করেন অনেকে।
"তিনি দলকে নেতৃত্ব দিবেন একটা নির্বাচনী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। তার কাছে যে প্রত্যাশার চাপ, এই প্রত্যাশা পূরণ করার ক্ষেত্রে তার অনেক সমস্যা আছে। কারণ তিনি ১৭ বছর দেশের বাইরে। তিনি যতই ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখুন বা নেতৃত্ব করুন, ইংরেজিতে গ্রাউন্ড রিয়েলিটি বলে একটা বিষয় আছে, যে সত্যি বাস্তব অবস্থাটা কেমন যখন তার মুখোমুখি হবেন" সেসবের চ্যালেঞ্জ থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন।
বিএনপির প্রবীণ ও তরুণ পর্যায়ে নেতাদের বিভিন্ন অনুরোধ এবং সেসবের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা নির্বাচনের আগে অন্তত সম্ভব হবে বলে মনে করছেন না অধ্যাপক শামীম রেজা। সেসব আলোচনা নির্বাচনের পড়ে আরও প্রকট হতে পারে বলে বিবিসির বাংলাদেশ ট্রেন্ডিং অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়া তারেক রহমান দেশে ফেরার পর তাকে ঘিরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেপরোয়াভাব চলে আসতে পারে, এমন আশঙ্কাও বেশ আগে থেকেই করেছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
বিশেষ করে নির্বাচনের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় বিএনপি জয়ী হতে যাচ্ছে, এমন ধারণা থেকে ব্যবসায়ী, সিভিল সোসাইটি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের নেতাদের মধ্যেও বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে।
আবার বিএনপি ও আরও অনেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র নিয়ে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে। নির্বাচনী অনিরাপত্তার শঙ্কা তো আছেই।
বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেনের মতে, "বিএনপির মতো বড় দল আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে একটি গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থি দলের অভাব দেশের মানুষ বোধ করেন, তাদের যে প্রত্যাশা থাকবে সেটি পূরণ করাও বিএনপির জন্য বেশ কঠিন হবে"।
অবশ্য নির্বাচন কাছে চলে এলে কোনো না কোনোভাবে দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার অন্তত সমাধান হয়ে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে বলে মনে করেন মোজাম্মেল হোসেন।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের মতে, দেশের সার্বিক খারাপ অবস্থা আর মানুষের প্রত্যাশা পূরণের দিকগুলোই দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
তারেক রহমান দেশের রাজনীতিতে ফিরলে নেতাকর্মীদের মনোবলের দিক দিয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করার বিষয়ে আগে থেকেই বলা হচ্ছিল। এর প্রতিফলন অনেকটা দেশে আসার সাথে দলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতেও বোঝা গেছে। কিন্তু সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জনগণের আস্থা কতটা ফেরাতে পারবেন, সেদিকে নজর থাকবে অনেকের।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
ভিওডি বাংলা/ এমএম/এমএইচ






