• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

রাজনীতির প্রতি অনীহা থেকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক    ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০৪ পি.এম.
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ছবি- সংগৃহীত

বেগম খালেদা জিয়া
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর শোকাবহ পরিস্থিতিতে দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেই সময় শোক, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দলীয় বিভাজনে বিপর্যস্ত বিএনপির নেতৃত্ব সংকট দেখা দেয়। রাজনীতিতে অনাগ্রহী এই গৃহবধূকে শেষ পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজনে দলের হাল ধরতে এগিয়ে আসতে হয়। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দলের প্রভাবশালী নেত্রী। মাত্র এক দশকের মধ্যেই তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুই দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিতে কোন্দল ও নতুন নেতৃত্ব

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার আগমন মোটেও সহজ ছিল না। শুরুতে রাজনীতিতে তার আগ্রহ সীমিত ছিল এবং তিনি মূলত পরিবার ও গৃহকর্ম নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তবে স্বামীকে হারানোর পর দেশ, দল ও সময়ের চাহিদাই তাকে সামনে নিয়ে আসে। 

মূলত জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির নেতৃত্বে শুরু হয় তীব্র মতবিরোধ। তড়িঘড়ি করে ৭৮ বছর বয়সী ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করা হলেও দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষ বাড়তেই থাকে। দলের একটি প্রভাবশালী অংশ তখন এই সংকট কাটাতে খালেদা জিয়াকে রাজনীতে আনার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি তখনও খালেদা জিয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। বারবার অনুরোধ, বোঝানোর পর দলীয় নেতারা খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসতে বাধ্য করেন। তাদের যুক্তি ছিল— খালেদা জিয়া নেতৃত্ব না নিলে দল টিকবে না।

এদিকে, খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ছিলেন শঙ্কিত। তার ভয় ছিল খালেদা জিয়া নেতৃত্বে এলে তার ক্ষমতা দখলের পথ কঠিন হয়ে যাবে। সব আশঙ্কা ও চাপের মধ্যে অবশেষে দলের নেতাদের অনুরোধে এগিয়ে আসেন খালেদা জিয়া।

১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি কর্মী হিসেবে বিএনপির রাজনীতিতে নাম লিখান তিনি। এরপর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া শুরু করেন। একই বছরের ৭ নভেম্বর জিয়ার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ দেন, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে দলের তরুণ অংশ তাকে দলীয় প্রধান হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু খালেদা জিয়ার পাশাপাশি সেসময় রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারও বিএনপির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন। এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলে খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান পদ থেকে তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সাত্তার তখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান থাকলেও দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে।

১৯৮৩ সালের মার্চে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন। এর কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

একদিকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছিল, অন্যদিকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। তিনি হয়ে উঠেন আপসহীন নেত্রী। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে।

রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নিয়ে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে দেয়নি। 

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া, কারাভোগ করেছেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত মানুষটি খালেদা জিয়া। চিকিৎসার সুযোগও দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বেগম জিয়া। এরপর করোনার কারণে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিলেও গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় বন্দি রাখা হয়। এরমধ্যে ২০২৪ সালের জুলাইতে কোটা সংস্কার আন্দোলন দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন, যা শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে গড়ায়। টানা ৩৫ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। পরদিন ৬ আগস্ট খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। 

জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠলেন খালেদা জিয়া

আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন নির্বাচন ঘিরে তীব্র অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন বেগম খালেদা জিয়া।

৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আকস্মিকভাবে নির্বাচন আয়োজনের একটি সময়রেখা ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই তিনি জানান, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছিল। প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতে তৈরি হয় তীব্র উত্তাপ।

ঘোষণার পরদিন রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যখন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে মুখোমুখি অবস্থানে যায়, তখনই সমাধানের পথে এগিয়ে আসেন বেগম জিয়া।

স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ডেকে তিনি জানতে চান সরকার ও দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণ। সব শুনে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন—এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করা যাবে না। সহনশীলতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে হবে। দেশের সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ গণতন্ত্র।

শুধু দলের নেতাদের সঙ্গেই নয়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার নির্দেশেই তা স্থগিত করা হয়। তার পরামর্শেই পরবর্তীতে লন্ডনে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বেগম জিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী বিএনপি নির্বাচন সময়সূচি নিয়ে অবস্থান নমনীয় করে। জাতির বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ, অর্থাৎ রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দেয় দলটি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ইস্যুতে যখন অন্তর্বর্তী সরকার ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সমঝোতার পরিবেশ তৈরি এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে বেগম জিয়ার পরামর্শ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই দৃষ্টান্ত তাকে আবারও জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করেছে।

শুধু এবার নয়, ১৯৮২ সালে রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে বেগম জিয়া সবসময়ই দেশের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া, কারাভোগ করেছেন। চিকিৎসার সুযোগও দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বেগম জিয়া। এরপর করোনার কারণে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিলেও গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় বন্দি রাখা হয়। 

আওয়ামী লীগের শাসনামলে চিকিৎসা না পাওয়ায় ধীরে ধীরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয় খালেদা জিয়ার।

এরমধ্যে ২০২৪ সালের জুলাইতে কোটা সংস্কার আন্দোলন দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন, যা শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে গড়ায়। টানা ৩৫ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। পরদিন ৬ আগস্ট খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। 

এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। ১১৭ দিন লন্ডনে অবস্থান শেষে গত ৬ মে তিনি দেশে ফেরেন। তার স্বাস্থ্যের অনেকটা উন্নতি হয়েছিল। তবে নানা রোগে জটিলতা ও শরীর–মনে ধকল সহ্য করে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও ছিল প্রতিকূল। প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাসপাতালে ভর্তি করানো হতো। 

সবশেষে গত ২৩ নভেম্বর তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক মাসের কিছু বেশি সময় তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সার্বিক কার্যক্রম কো-অর্ডিনেট করতে কেবিনেট বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলাম
সার্বিক কার্যক্রম কো-অর্ডিনেট করতে কেবিনেট বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলাম
রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার ৪১ বছর
রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার ৪১ বছর
খালেদা জিয়ার অবদান দেশ ও জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে- আবদুস সালাম
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ভিওডি বাংলা’র সম্পাদক আবদুস সালামের শোক খালেদা জিয়ার অবদান দেশ ও জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে- আবদুস সালাম