গৃহকর্মীর পরিচয় ছাপিয়ে খালেদা জিয়ার ছায়াসঙ্গী ফাতেমা

দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা বেগম। কারাজীবনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ, নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী থাকা, হাসপাতালের বিছানা কিংবা বিদেশ সফর—সবখানেই নীরবে পাশে থেকেছেন তিনি। গৃহকর্মীর পরিচয় পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খালেদা জিয়ার একান্ত বিশ্বস্ত সঙ্গী।
বাথরুমে আনা নেওয়া, মুখে তুলে ওষুধ খাওয়ানোসহ দৈনন্দিন সেবাযত্নের কাজ করতেন ফাতেমা। শারীরিকভাবে দুর্বল মুহূর্তগুলোতে হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। কোনো চাওয়া–পাওয়া ছাড়াই আমৃত্যু খালেদা জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন ফাতেমা।
সংসারের দায় আর জীবনের সংগ্রাম
ফাতেমা বেগমের গ্রামের বাড়ি ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রামে। রফিকুল ইসলাম ও মালেকা বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়।একই ইউনিয়নের কৃষক মো. হারুন লাহাড়ির সঙ্গে বিয়ের পর তাঁদের সংসারে আসে মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। মেঘনা নদীর চরে কৃষিকাজ করেই চলত সংসার। ছেলের বয়স তখন মাত্র দুই বছর। ২০০৮ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তাঁর স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট সন্তান নিয়ে দুঃখের মধ্যে পড়েন ফাতেমা।
পরিবারের হাল ধরতে সন্তানদের নিয়ে ফিরে যান বাবা মায়ের কাছে। মুদি দোকানি বাবার আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে ২০০৯ সালে কাজের খোঁজে ঢাকায় আসেন ফাতেমা।
জিয়া পরিবারে যুক্ত হওয়ার গল্প
ঢাকায় আসার পর পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে ওই বছরই বেগম খালেদা জিয়ার গৃহকর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ পান ফাতেমা। তখন থেকেই যেখানে খালেদা জিয়া, সেখানেই ফাতেমা। প্রতিকূল–অনুকূল সব পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে ছিলেন অবিচল।
মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে নজরে আসা
২০১৪ সালে বিএনপির ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির সময় দেশবাসীর নজরে পড়েন ফাতেমা বেগম। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। নয়াপল্টনে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুভর্তি ট্রাক রেখে বাধা সৃষ্টি করা হয়। গাড়িতে উঠে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর রওনা হতে না পেরে বাসভবনের দোরগোড়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন খালেদা জিয়া। সেই সময় পুলিশের চাপে ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। তখন শক্ত করে তাঁর হাত ধরে পাশে ছিলেন ফাতেমা। ওই দৃশ্য গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
কারাগারেও সঙ্গী
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে আদালত খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দেন। তাঁকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। আইনজীবীরা আদালতে তাঁর গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে সঙ্গে রাখার আবেদন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি আদালত খালেদা জিয়াকে ডিভিশন দেওয়ার পাশাপাশি ফাতেমাকে সঙ্গে রাখার আবেদন মঞ্জুর করেন। কারাগারে নেওয়ার ছয় দিন পর ফাতেমা তাঁর সঙ্গে থাকার অনুমতি পান।
হাসপাতাল ও করোনাকাল
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে করোনায় আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত টানা ৫৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। করোনা মহামারির ভয়াবহ সময়ে তখনও ফাতেমা ছিলেন তাঁর পাশে। সেবাযত্নে কোনো ঘাটতি রাখেননি তিনি।
লন্ডন সফরেও পাশে
সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়া হয়। ওই সফরেও তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা বেগম। এর আগেও একাধিকবার খালেদা জিয়ার বিদেশ সফরে সঙ্গী হয়েছেন তিনি। ফাতেমা বেগমের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। গৃহকর্মীর পরিচয় ছাপিয়ে মানবিকতা, নিষ্ঠা আর দায়িত্ববোধ দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খালেদা জিয়ার পরিবারেরই একজন।
ভিওডি বাংলা/ এমএম/এমপি







