রাজপথ থেকে ইতিহাসের পাতায়: খালেদা জিয়ার চিরবিদায়

বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ, উত্তাল অধ্যায় আজ স্থায়ীভাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান নিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে রাজপথের রাজনীতি হারাল তার অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠস্বরকে, আর জাতি হারাল এমন এক নেত্রীকে যিনি দেশ ও জনগণের জন্য পুরা জীবন ব্যয় করেছেন। তার বিদায় মানে শুধু একজন রাজনীতিকের মৃত্যু নয়; এটি এক যুগের পরিসমাপ্তি।
খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ ছিল আকস্মিক। স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নেতৃত্বশূন্য বিএনপির হাল ধরেই তিনি সামনে আসেন। রাজনীতিতে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু সময় খুব দ্রুতই তাকে পরিণত করে দৃঢ়চেতা নেত্রীতে।
১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে আরও দুই দফা রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে তিনি প্রমাণ করেন কেবল উত্তরাধিকার নন, বরং নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী।
রাজপথের রাজনীতি ও দ্বন্দ্বের যুগ:
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন সবচেয়ে বেশি চিহ্নিত হয়েছে রাজপথকেন্দ্রিক আন্দোলনে। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিভক্ত করেছে দুই বিপরীত মেরুতে। একজনকে বলা হয় স্বৈরাচার। আর একজনকে বলা হয় দেশনেত্রী। একজন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আর একজন শত নির্যাতনের মধ্যেও দেশে রয়ে গিয়েছেন। নির্বাচন, আন্দোলন, সংসদ বর্জন ও সরকার পতনের ডাক সবই ছিল তার রাজনৈতিক অস্ত্র। সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন আপসহীন গণতন্ত্রের প্রতীক, আর সমালোচকদের চোখে কঠোর ও অনমনীয় এক নেত্রী।
এই দ্বন্দ্বই গড়ে তুলেছে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়গুলোর একটি। ক্ষমতার বাইরে কঠিন সময় জীবনের শেষ দশকে খালেদা জিয়ার জীবন হয়ে ওঠে সংগ্রামের আরেক রূপ। মিথ্যা দুর্নীতি মামলায় কারাবাস, গুরুতর অসুস্থতা ও বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে জটিলতা সব মিলিয়ে তিনি এক দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
একসময় যিনি রাজপথ কাঁপিয়েছেন, শেষ দিকে তিনি ছিলেন অনেকটাই নিঃসঙ্গ ও নীরব। তবু তার নাম কখনো রাজনীতির কেন্দ্র থেকে পুরোপুরি সরে যায়নি।
মৃত্যু ও শোকের আবহ:
তার মৃত্যুর খবরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। বিএনপি সাত দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্র তিন দিনের শোক ঘোষণা এবং একদিনের ছুটি করেছে। সমর্থকরা হারিয়েছেন তাদের নেত্রীকে, আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হারিয়েছে এক দীর্ঘদিনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে।
ইতিহাসের বিচারে খালেদা জিয়া:
খালেদা জিয়া ছিলেন একসঙ্গে
একজন শক্তিশালী নারী রাষ্ট্রনায়ক, রাজপথনির্ভর রাজনীতির প্রতীক ও অবিচ্ছেদ্য রাজনৈতিক চরিত্র। তিনি ছিলেন না সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তিনি ছিলেন অপরিহার্য। তার জীবন ও রাজনীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
রাজপথে তার কণ্ঠ আর শোনা যাবে না।
মিছিলের সামনে আর তাকে দেখা যাবে না। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় বেগম খালেদা জিয়া থাকবেন একটি সময়ের নাম ও রাজনৈতিক যুগের সাক্ষী হয়ে। রাজপথ থেকে ইতিহাসের পাতায় এভাবেই শেষ হলো খালেদা জিয়ার দীর্ঘ যাত্রা।
ভিওডি বাংলা-সবুজ/জা







