• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

খালেদা জিয়া

একটি নাম, একটি নীরব প্রতিজ্ঞা

মোক্তাদির হোসেন প্রান্তিক    ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৮ পি.এম.
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ছবি- সংগৃহীত

তিনবার প্রধানমন্ত্রী। কখনও নির্বাচনে পরাজিত নন। দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। কিন্তু এই পরিচয়গুলোও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণতা প্রকাশ করে না। খালেদা জিয়া ছিলেন মূলত এক নীতির নাম, আপসহীনতার রাজনীতি। 

রাজনীতিতে কিছু নাম কেবল ব্যক্তি নয়, তারা সময়, দর্শন ও প্রতিরোধের প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই একটি নাম। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দিশেহারা এক দল, বিপর্যস্ত এক পরিবার ও অস্থির এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতর দাঁড়িয়ে যিনি নিজের ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপ দিয়েছিলেন, তিনিই খালেদা জিয়া। 

তিনবার প্রধানমন্ত্রী। কখনও নির্বাচনে পরাজিত নন। দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। কিন্তু এই পরিচয়গুলোও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণতা প্রকাশ করে না। খালেদা জিয়া ছিলেন মূলত এক নীতির নাম, আপসহীনতার রাজনীতি।

শোক থেকে শক্তি: রাজনীতিতে এক অনিবার্য আবির্ভাব

১৯৮১ সালের ৩০ মে। চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মুহূর্তেই বদলে যায় খালেদা জিয়ার জীবন। তিনি তখন রাজনীতির বাইরের একজন সাধারণ গৃহবধূ, দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

কিন্তু ইতিহাস অনেক সময় ব্যক্তির প্রস্তুতি দেখে না, প্রয়োজন দেখে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গভীর সংকটে পড়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি। নেতৃত্বহীন, বিভক্ত ও দিশেহারা দলটিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনে জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনুরোধেই ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন খালেদা জিয়া।

রাজনীতির প্রথাগত কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই, মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৪ সালে দায়িত্ব নেন বিএনপির চেয়ারপারসনের। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ, কঠিন ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক যাত্রা।

স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান, ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা

আশির দশকের সামরিক শাসন, এরশাদের শাসনামল, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন, কারাবরণ করেন। কিন্তু আন্দোলনের প্রশ্নে কখনও আপস করেননি।

১৯৮৬ সালে যখন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি ভেঙে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেন, তখনও খালেদা জিয়া নিজের অবস্থান থেকে একচুলও সরেননি। ‘এরশাদ হটাও’ এক দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েই জনগণের কাছ থেকে তিনি পান ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি। এই আপসহীনতা কেবল রাজনৈতিক কৌশল ছিল না; ছিল তাঁর আদর্শের বহিঃপ্রকাশ।

গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা; ক্ষমতায় ও বিরোধীদলে একই দৃঢ়তা

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর জনগণ ফিরিয়ে দেয় গণতন্ত্র। সেই নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের মাধ্যমে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও যুক্ত হয় তাঁর নামের সঙ্গে।

এরপর ১৯৯৬ সালে (সংক্ষিপ্ত মেয়াদে) ও ২০০১ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তিনবার ক্ষমতায় যাওয়া এবং প্রতিবারই নির্বাচনে জয়ী হওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, একই সঙ্গে সর্বোচ্চ আসন নিয়ে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। ক্ষমতায় যেমন দৃঢ়, বিরোধী দলে থেকেও তেমন আপসহীন-এই ধারাবাহিকতাই তাঁকে করেছে আলাদা।

সংকট, কারাবাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতি

২০০৭ সালের এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আবারও গভীর সংকটে পড়ে বিএনপি। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার রাজনীতি, গ্রেপ্তার, কারাবাস সবকিছুর মধ্যেও খালেদা জিয়া আপস করেননি।

বিদেশে যাওয়ার নানা চাপ উপেক্ষা করে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।’ আদালতে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি কখনোই অন্যায় কিছু করিনি।’ ২০২৪ সালের রাতের ভোটের প্রতিবাদ জানিয়ে রাজপথে নামার পথে বালুর ট্রাক দিয়ে তাঁকে বাধা দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না, আমি এগিয়ে যাবই। আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে ভয় করিনা।’

কথিত দুর্নীতি মামলায় তাঁকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। পুরান ঢাকার জরাজীর্ণ কারাগারে দেড় বছরের বেশি সময় কাটাতে গিয়ে তিনি আক্রান্ত হন নানা জটিল রোগে। গুরুতর অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চাওয়া হলেও তৎকালীন সরকার তা দেয়নি। যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এক নির্মম দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হয়। সেই বিচারে তিনি আক্ষরিক অথেই ‘মজলুম’। 

গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্ত মানুষের প্রত্যাবর্তন

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তিনি বেকসুর খালাস পান। দীর্ঘ সময় পর মুক্ত মানুষ হিসেবে তাঁর প্রথম জনসমক্ষে উপস্থিতি ঢাকা সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে। যা পরিণত হয় এক আবেগঘন জাতীয় দৃশ্যে।
দেশের শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, সব দলের রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে সম্মান জানান। সেই মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে খালেদা জিয়া আর কেবল একটি দলের নেত্রী নন; তিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে এক জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।

দল-মতের ঊর্ধ্বে এক ঐক্যের প্রতীক

চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাত্রা কিংবা দেশে ফেরা, প্রতিটি মুহূর্তেই রাজপথে নেমে আসে মানুষের ঢল। গুলশান থেকে বিমানবন্দর, ৬ কিলোমিটার জুড়ে ভালোবাসার মানবস্রোত। কাতারের আমিরের পাঠানো রাজকীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, সবই তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মানের বহিঃপ্রকাশ। শেষ জীবনে এসে তিনি হয়ে ওঠেন দল-মতের ঊর্ধ্বে এক জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।

অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে দেখতে যান সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানসহ দেশের শীর্ষ নেতারা। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিবৃতি, সাধারণ মানুষের দোয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে দোয়া ও প্রার্থনা, সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া পরিণত হন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক সর্বজনীন প্রতিচ্ছবিতে। 

শেষ কথা: একটি নাম, একটি নীরব প্রতিজ্ঞা

কিছু মানুষ ক্ষমতায় গিয়ে বড় হন না, ক্ষমতাই তাদের ছুঁয়ে মহিমান্বিত হয়। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন তেমনই একজন। জীবনের শুরুতে যিনি ছিলেন নীরব, নিভৃত এক গৃহবধূ, সময়ের প্রয়োজনে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রতিরোধের ভাষা, আপসহীনতার প্রতীক, গণতন্ত্রের অবিচল পাহারাদার।

ব্যক্তিগত শোক, কারাবাস, অসুস্থতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কোনো কিছুই তাঁকে নীতির পথ থেকে সরাতে পারেনি। তিনি আপস করেননি ক্ষমতার জন্য, নিরাপত্তার জন্য, এমনকি নিজের আরামের জন্যও নয়। দেশের মাটি, মানুষের অধিকার আর গণতন্ত্র, এই তিনের বাইরে তাঁর কোনো ঠিকানা ছিল না।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, রাজনীতি কেবল জয়ের হিসাব নয়, তা হলো অবস্থান নেওয়ার সাহস। হার না মানার দৃঢ়তা। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে একা হয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তি।

বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী নন, তিনি ছিলেন একটি সময়ের অভিভাবক, একটি প্রজন্মের প্রেরণা, একটি জাতির দীর্ঘ লড়াইয়ের নীরব প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি থেকে যাবেন—
একটি নাম হয়ে নয়,
একটি আদর্শ হয়ে,
একটি আপসহীন প্রতিজ্ঞা হয়ে।
ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে- যিনি মাথা নত করেননি, যিনি হার মানেননি, যিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকেই রেখে গেছেন উদাহরণ হিসেবে।

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
অপরিচিত চ্যালেঞ্জের সামনে তারেক রহমান
অপরিচিত চ্যালেঞ্জের সামনে তারেক রহমান
বিএনপির ৩১ দফা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার
বিএনপির ৩১ দফা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার
নিরাপত্তা নিয়ে তবুও শঙ্কা
নিরাপত্তা নিয়ে তবুও শঙ্কা