• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

অন্তর্মুখী গৃহবধূ থেকে রাজপথের অগ্নিকন্যা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক    ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৬ এ.এম.
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘আপসহীন’ শব্দটি এখন আর কেবল একটি সাধারণ বিশেষণ নয়; বরং এটি একটি নামের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে- বেগম খালেদা জিয়া। একজন সাধারণ ‘অন্তর্মুখী গৃহবধূ’ থেকে সময়ের প্রয়োজনে রাজপথের অগ্নিকন্যা হয়ে ওঠা এই নারীর জীবন কাহিনী বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার এক জীবন্ত উপাখ্যান, আপসহীনতার অবিনশ্বর প্রতীক। যা উপমহাদেশের রাজনীতিতে বিরল। 

১৯৮১ সালে স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের পর যখন বিএনপি ও দেশ এক চরম অনিশ্চয়তায়, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। সেনাপ্রধানের স্ত্রী বা ফার্স্ট লেডি- কোনো পরিচয়ই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। 

সাদা শাড়ি পরে শোকাতুর হয়ে ঘরে বসে না থেকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাজপথকে। খুনি ও স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি ধারণ করেছিলেন এক ‘অগ্নিমূর্তি’। পায়ের পাতায় ধুলো মেখে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া চষে বেড়িয়েছেন তিনি, যা মানুষকে অভাবনীয়ভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও সরলতা

খালেদা জিয়ার রাজনীতির মূল শক্তি ছিল তাঁর সরলতা, নম্রতা এবং অদম্য সাহসিকতা। গ্রামের সাধারণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই নারীর ছিল এক মায়াবী মিষ্টি হাসি এবং মানুষকে খুব দ্রুত আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বলতেন এবং যা বলতেন তা বাস্তবায়নে অটল থাকতেন। 

আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের কট্টর ইসলামিক স্কলাররাও তাঁর পোশাক বা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কখনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। তিনি ভোটের জন্য কখনো লোক দেখানো ধর্মীয় পোশাকের আশ্রয় নেননি, বরং নিজের স্বকীয়তা দিয়েই জয় করেছিলেন সর্বস্তরের মানুষের মন।

আপসহীনতার দীর্ঘ ৯ বছর (১৯৮২-১৯৯০)

আশির দশকে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল কিংবদন্তিতুল্য। ৯ বছরের সেই দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি বহুবার গৃহবন্দী হয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতার ভাগ নিতে কোনো সমঝোতা করেননি। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে তাঁর সেই ইস্পাতকঠিন অনড় অবস্থানের কাছেই নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল স্বৈরাচার। তাঁর এই আপসহীনতার কাছে হার মানতে হয়েছে তাঁর দীর্ঘদিনের কট্টর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও।

ওয়ান-ইলেভেন এবং ‘বিদেশে কোনো ঠিকানা নেই’

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। যখন অনেক বড় বড় নেতা চাপের মুখে দেশ ছাড়ছিলেন বা আপস করছিলেন, তখন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন পাহাড়ের মতো অটল হয়ে। 

দেশত্যাগের অকল্পনীয় চাপের মুখে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- ‘বিদেশে আমার কোনো ঘর নেই, কোনো ঠিকানা নেই। এ দেশের মাটি আর মানুষই আমার সব। মরলে এ দেশের মাটিতেই মরব। এমনকি শেখ হাসিনার স্বৈরাচারি আমলেও কারাগারে নিঃসঙ্গ লড়াই আর দুই সন্তানের ওপর অমানবিক নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি মাথা নোয়াননি।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে হিমালয়সম অনড়

২০০৯ পরবর্তী দীর্ঘ শাসনামলে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার নানা চেষ্টা চালানো হয়েছে। নির্জন কারাগার থেকে শুরু করে হাসপাতালের কেবিনে বছরের পর বছর তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছে। গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার শর্ত হিসেবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েও তিনি প্রমাণ করেছেন- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ। তাঁর এই ধৈর্যের মাধ্যমেই তিনি কোটি মানুষের হৃদয়ে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের মাতা’ হিসেবে স্থান করে নেন।

চব্বিশের বিপ্লব ও সম্প্রীতির বার্তা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার রক্তঝরা বিপ্লব যেন ছিল তাঁর দীর্ঘ ত্যাগের এক ঐতিহাসিক প্রতিদান। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতনের পর যখন তিনি মুক্ত বাতাসে ফিরে আসেন, তাঁর প্রথম বার্তাই ছিল প্রতিহিংসাহীন সমাজ গড়ার। দীর্ঘ বন্দিত্ব তাঁর শরীরকে জীর্ণ করলেও তাঁর অপরাজেয় মনোবলকে যে স্পর্শ করতে পারেনি, তা দেশবাসী নতুন করে প্রত্যক্ষ করেছে।

খালেদা জিয়া আজ কেবল একটি দলের নেত্রী নন; তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাহসের এক মূর্ত প্রতীক। সার্বভৌমত্ব আর জনমতের সুরক্ষাই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল আবর্তন। যখনই এ দেশের গণতন্ত্র সংকটে পড়বে, বেগম জিয়ার ‘আপসহীন’ জীবনগাঁথা আগামী প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করবে। তিনি শিখিয়ে গেছেন- বিপদের সামনে মাথা নত না করাই হলো প্রকৃত দেশপ্রেম।

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে খালেদা জিয়া
সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে খালেদা জিয়া
মায়ের মরদেহের পাশে কোরআন তেলাওয়াত করছেন তারেক রহমান
মায়ের মরদেহের পাশে কোরআন তেলাওয়াত করছেন তারেক রহমান
‘আপসহীন’ নেত্রীর অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি
‘আপসহীন’ নেত্রীর অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি