বেদনাবিধুর এই মুহূর্তে আমাদের উচিত জাতি গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া

সম্ভবত এই মুহূর্তে সবচেয়ে উপযুক্ত হবে কিছু উদ্ধৃতি স্মরণ করা—'চোখের আড়াল হলেও রয়ে যাবেন মননে', 'অধ্যায় শেষ হয়, চলতে থাকে গল্প', 'নেতা বিদায় নেন, কিন্তু থেকে যায় আদর্শ'। হ্যাঁ, তিনি আমাদের মননে থাকবেন, প্রয়াণের পরও শেষ হবে না তার গল্প এবং তিনি চলে গেলেও কেবল টিকেই থাকবে না, বরং নতুন করে জাগ্রত হবে গণতন্ত্রের আদর্শ।
পুরো জাতি খালেদা জিয়ার প্রয়াণে শোকাহত। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দ্য ডেইলি স্টারও জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। বিশ্বের বহু নেতা যখন এই অপূরণীয় ক্ষতিতে শোকবার্তা জানাচ্ছেন, তখন তার স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে আমরা আবারও প্রতিজ্ঞা করছি—গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। নতুন করে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তার সরকারের প্রথম মেয়াদকাল ছিল গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে স্বাধীন সময়গুলোর একটি। এ জন্যও আমরা তাকে শ্রদ্ধা জানাই।
এত সংগ্রাম ও ত্যাগের পরও জীবদ্দশায় প্রাপ্য সম্মান পাননি খালেদা জিয়া। সাত বছরেরও বেশি সময় তাকে কারান্তরীণ ও গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়েছে—যা ছিল আইনের অপব্যবহারের এক দৃষ্টান্ত। তিনবারের নির্বাচিত এই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বন্দিদশায় যে আচরণ করা হয়েছে, তা ছিল মর্যাদাহানিকর। দুই বছরের বেশি সময় তাকে নির্জন কারাবাসে রাখা ছিল নিষ্ঠুর ও অমানবিক।
তার স্বামী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দলটি হয়ে পড়ে নেতৃত্বহীন। সেই অবস্থায় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসতে বাধ্য হন। আত্মপ্রচারবিমুখ ও রাজনীতির জগতে অনভিজ্ঞ গৃহবধূ হয়েও তিনি ধীরে ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে দল ও দেশের রাজনীতিতে নিজের ছাপ রেখে গেছেন। সুযোগসন্ধানীদের মতো আপস না করার যে দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছিলেন, সেটাই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়ের অন্যতম মূল কারণ।
আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার অবদান ছিল অসামান্য। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তার বিজয় ছিল অভূতপূর্ব। এর মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া দৃঢ় ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যসম্পন্ন এক রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
এরশাদের সমঝোতার প্রস্তাবের কাছে নতি স্বীকার করতে বারবারই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। আর সেই কারণেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির যে রাজনৈতিক ভূমিকা, তা সম্পূর্ণভাবে খালেদা জিয়ার কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে দল ও দলের নেত্রী জায়গা করে নেয় সাধারণ মানুষের মনে। এ দেশের জনগণ বুঝতে পারে—এখানে এমন একজন নেত্রী আছেন, যার কথা ও কাজে মিল আছে এবং লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েও তাকে টলানো যায় না।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু, নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করে যথাযথভাবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন মর্যাদাসম্পন্ন, সংবেদনশীল, ভিন্নমতের প্রতি উদার, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নিজের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। তিনি জানতেন, তার শেখার অনেক কিছু আছে এবং সেই শেখার প্রচেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।
বিদ্যমান রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়ে নিজের রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রকৃত পরীক্ষা দেন তিনি। আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও জনগণের পছন্দ বিবেচনায় নিয়ে তিনি বিরোধীদের এই দাবি মেনে নেন। এতে তার উদারতা ও ভিন্নমত গ্রহণের সক্ষমতা প্রকাশ পায়, যা তিনি নিজে কখনো প্রচার করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির এক সুযোগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধীরা এটাকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করার সুযোগ হিসেবে না দেখে উল্টো নিরবচ্ছিন্ন হরতালের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে হয়রানি করতেই ব্যবহার করেছে—যা পরবর্তীতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
খালেদা জিয়ার প্রয়াণে আমরা শোকাহত। এমন সময়ে আমাদের উচিত বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রতি তার অঙ্গীকার নিয়ে ভাবা এবং তার দেখানো পথ ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া। আজ আমাদের সামনে অগণিত অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। আসুন, এই বেদনাবিধুর মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ও জনগণের প্রতি অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন করতে সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ হই।
লেখেক: মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ভিওডি বাংলা/ এমএম
নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়।

