মেলার মানুষ
মানুষ আছে মানুষ কই


খান মুহাম্মদ রুমেল
২৫ তারিখের বইমেলায়ও মানুষ নেই! মেলা যেন ভাঙা হাট। অথচ এই সময়ে এসে মেলা একেবারে জমজমাট থাকার কথা। অন্তত পক্ষে গত সাতাশ আটাশ বছরে মেলার এমন বেহাল অবস্থা আমার চোখে পড়েনি। তবে আশার কথা হলো এদিন মেলায় যারা এসেছেন প্রায় সবাই ছিলেন কেনাকাটায় ব্যস্ত। এই অল্প কিছু মানুষের আগমণ এবং তাদের বইকেনা দেখে এটা ধারণা করা যায়—এটাই আমাদের প্রকৃত পাঠক সংখ্যা। এতো দিন যে দল বেঁধে যে মানুষ এসেছেন, তারা মূলত ঘুরতে, দলবেঁধে ফুসকা চটপটি খেতে, ফুলের রিং মাথায় পরে বই হাতে বাঁকা ত্যারা হয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে এসেছেন। আর এসেছেন স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল বন্ধ করতে।
এসেছেন মেলায় কোন বইয়ে তথাকথিত আপত্তিকর কি আছে তার খোঁজ করতে। অহেতুক হট্টগোল বাঁধাতে। মেলার মাঠের ভিড় বাড়াতে। খুব বেশি নেতিবাচক কথা বলা হয়ে যাচ্ছে হয়তো। তবে যা বলছি— এটাই বাস্তবতা। এই রুঢ় সত্য বলতেই হবে। বালিতে মুখ গুঁজে থেকে আসলে কোনো লাভ নেই।
দুই তিন দিন আগে মেলায় এসেছে মহিউদ্দিন আহমদের এবারের মেলার শেষ বই— ’১৯৭১ কলকতা কোন্দল’। এর আগে যেদিন মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে কথা হয়— তিনি বলেছিলেন বইটা এবারই আসবে প্রথমা প্রকাশন থেকে। গত দুদিন আগে দেখলাম তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন বইটা অবশেষে প্রকাশ হয়েছে।
মঙ্গলবার মেলায় ঢুকে প্রথমে এই বইটা কিনি। তারপর সোজা চলে যাই পাঠক সমাবেশের প্যাভিলিয়নে— কিন নিই সতীনাথ ভাদুরির ’ঢোড়াই চরিত মানস’। আগের যে কপিটা ছিলো— হারিয়ে গেছে অথবা কেউ পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। এরপর কিনি নির্মলেন্দু গুণের I LOVE YOU.
কেনাকাটা শেষে অনিন্দ্য প্রকাশের সামনে এসে দাঁড়াই। জোবায়েরের বসে আছে মন খারপ করে। আমাকে দেখে বিষন্ন মুখে হাসে। হাসি আমিও।
— কি রে জোবায়ের কেমন আছিস?
— ভালো না ভাই। মেলায় এবার বেচাকেনা কম হবে ধারণা করেছিলাম। তাই বলে এতোটা খারাপ অবস্থা হবে ভাবি নাই ভাই।
— হুম। ছোট্ট করে উত্তর দিই আমি।
— ভাই দেখসেন, মেলায় কোনো মানুষই নাই। এইটা কোনো কথা?
— কি আর করবি? মানুষকে তো আর জোর করে পড়াতে পারবি না!
— সেটাই ভাই। কিছু ভালো লাগে না।
— খেয়েছিস কিছু? চল দুজন মিলে কিছু খাই।
— না ভাই, স্টল ছাইড়া বের হবো না।
— কেন, মানুষের ভিড় তো বেশি না। যারা আছে, সামলে নিতে পারবে।
— সেইজন্য না ভাই। মেলার সময় আমি আগেও কখনো স্টল ছাইড়া বাইর হই নাই। এখন যতোই মানুষ কম থাকুক আমি বাইরে যাবো না ভাই। বলতে পারেন এইটা আমার একটা খেয়াল।
— ঠিক আছে, থাক তাহলে। আমি একটু এগোই। ভালো থাকিস।
— আপনিও ভালো থাকেন ভাই।
জোবায়েরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। একা একা হাঁটি খানিকক্ষণ। চাইলে যে কাউকে খুঁজে আড্ডা দিতে পারি। আর কেউ না হোক, একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে মনি ভাইকে। কেন জানি কিছুই ভালো লাগে না। তারচেয়ে বরং বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তখনো সন্ধ্যা নামেনি। ধীরপায়ে হাঁটা ধরি আমি। টিসএসসি’র পাশের গেট দিয়ে বের হতে চাই। এখানে রাজ্যের মানুষের ভিড়। বারোয়ারি পণ্যের ভ্রাম্যমাণ দোকান নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা।
সেই ভিড়ে ছোটদের খেলনা থেকে শুরু করে থালা বাসনের দোকানি যেমন আছেন, আছেন চুড়ি কানের দুল নাকফুল বিক্রেতা। হাঁকডাক করে নুডলস সেমাই জুস পানিও বিক্রি করছেন বিভিন্ন কোম্পানির লোকেরা। আছে নানা রকম খাবারের দোকান। একেবারে চুলা খুন্তি কড়াই নিয়ে মেলার ভেতরে বসে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। হাঁটা পথে একজনের মন্তব্য কানে আসে— এটা কি আসলেই বইমেলা, নাকি বাণিজ্য মেলা! আসলেই তো তাই।
মেলা থেকে বের হয়ে এসে শাহবাগ পেরিয়ে হাঁটছি পরীবাগ সড়ক ধরে। এমন সময় ফোন করে কামরুল আহসান।
— দোস্ত তুই কি মেলায় আছিস?
— এই তো বের হয়ে এলাম মাত্র!
— ধুর ব্যাটা সন্ধ্যা হলে মেলা জমে আর তুই তখন বের হয়ে যাস!
— তুই যে আসবি, জানতাম না তো! জানলে থাকতাম।
— এখন কোথায়?
— পরীবাগ সড়কে হাঁটছি।
— আচ্ছা হাঁটতে থাক।
ফোন রেখে দেয় কামরুল। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে এই রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কত দুপুর বিকেল সন্ধ্যাকে রাত পর্যন্ত গড়িয়ে দিয়েছি আমি আর কামরুল। ’পরীবাগ সড়ক’ নামে একটা কবিতা আছে আমার। ’চোখের পল্লবে ঘুম নামে’ বইয়ে আছে কবিতাটা। প্রকাশের আগেই কবিতাটা পড়ে প্রশংসা করেছিলো কামরুল। কি আশ্চর্য অনেক চেষ্টা করেও সেই কবিতার একটা লাইনও মনে করতে পারছি না! খুব বিরক্ত লাগে নিজের ওপর।
ভিওডি বাংলা/এম