প্রশাসন সুশৃঙ্খলিত রাখতে কঠোর হচ্ছে আইন
প্রশাসনে বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ


মোক্তাদির হোসেন প্রান্তিক
কোনোভাবেই কাটছে না প্রশাসনের অস্থিরতা। প্রশাসনের সব স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, পদোন্নতি, ক্যাডার বৈষম্য, মহার্ঘ্য ভাতার দাবিসহ সচিবালয়ের কর্মচারীরা সোচ্চার নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় নিয়ে। এ নিয়ে পুরো প্রশাসনে চলছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ, আর হতাশা। এর মধ্যে সেই সময়ের অর্থাৎ গতবছরের ৫ আগস্টের আগে পুরো জুলাই মাসজুড়ে দায়িত্ব পালনকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম এই অস্থিরতা, ক্ষোভ ও হতাশার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সচিবালয়ে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন দমাতে সরকারের নির্দেশে দায়িত্ব পালনকারী একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ওই সময় কারা কারা মাঠে এই দায়িত্ব পালন করেছেন; রেকর্ড দেখে তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এর আগে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনকারী সাবেক ডিসিদের প্রত্যাহার করে এনে তাদের ওএসডি করা হচ্ছে এবং কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। যাদের চাকরির বয়স ২৫ পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসবকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের অভ্যন্তরে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
সূত্র জানিয়েছে, এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করলেও বিশেষ করে বিসিএস ৩৩ থেকে ৪৩তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যেই অধিক মাত্রায় ক্ষোভ, হতাশা ও আতঙ্ক কাজ করছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা ডিসির দায়িত্বপালন করেছেন, তারা সবাই বর্তমান প্রশাসনের রেড জোনে রয়েছেন। যদিও বলা হচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ে যারা ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অর্থাৎ শুধু ডিসি থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কারণ ডিসি প্রশাসন ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত একটি পদ এবং যোগ্য যে কোনও কর্মকর্তাকে সরকার ডিসি হিসেবে নিয়োগ দিলে তাকে সে দায়িত্ব পালন করতেই হয়। তাই ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যারা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, সেই সরকারের দেওয়া বিতর্কিত নির্বাচন সফল করার কারণে তাদের বিষয়ে সরকারের অবস্থান কঠোর বলে জানা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৮ জুলাই নরসিংদীতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহমিদ ভুঁইয়া। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের এই ঘটনায় নরসিংদীতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অনির্বাণ চৌধুরীকে গ্রেফতারের ঘটনাটি প্রশাসনকে বেশি অস্থির করে তুলেছে। এ ঘটনায় শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক, ক্ষোভ ও হতাশা। এই ঘটনায় বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে বেশি। তাদের দাবি, তৎকালীন সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে কোনও নিয়মনীতির ধার ধারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আন্দোলন দমাতে পুলিশ নিজেদের মতো করেই গুলি করেছে। অনেক ক্ষেত্রে গুলি করার আগে ম্যাজিস্ট্রেটদের অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয়নি। অথচ সেই সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় গুলি চালানোর মতো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে চাপ দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছ থেকে (ম্যাজিস্ট্রেট কমান্ড সার্টিফিকেট) এমসিসিতে সই নেওয়া হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা সই দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে এ বিষয়টি নিয়ে কেউই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে সম্মত হননি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই পুলিশকে গুলির নির্দেশ দেওয়ার দায়ে এ বছরের ১৫ এপ্রিল নরসিংদীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অনির্বাণ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের আবেদনের শুনানির পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। এ ঘটনার পর গুলির নির্দেশদাতা সিনিয়র কর্মকর্তাদের নীরবতা দেখে নরসিংদী জেলা প্রশাসনে কর্মরত অন্যান্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। গত ৫ আগস্টের পর নরসিংদীর সেই সময়ের জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলমকে চট্টগ্রামের উপভূমি সংস্কার কমিশনার পদে বদলি করা হয়।
সচিবালয়ের বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতারের ঘটনার পরের দিন ১৬ এপ্রিল বুধবার ছিল ‘টক অব দ্য সচিবালয়’। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকে ফোন করে নিজেদের আতঙ্কের কথা জানান বলেও জানা গেছে। তাদের দাবি, পুলিশের দাবির মুখে মাঠ প্রশাসনের এসব নবীন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে না থেকেও নির্দেশদাতা হিসেবে এমসিসিতে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেকে টেলিফোন করে এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা।
একই সঙ্গে ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় ও জুলাইয়ের কোটা বিরোধী আন্দোলন দায়িত্ব পালনকারী ডিসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অলিখিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিসিএস ২৪ ব্যাচের ৭২ জন কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের সময় বিসিএস ২৪ ব্যাচের ২৫ কর্মকর্তা ডিসি ছিলেন। এরই অংশ হিসেবে অধিকাংশ ডিসিকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, তাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলেই তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে। চাকরি হারানোর ভয়ে এসব কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন।
ডিসি হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় যারা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তাদের বিষয়ে সরকারের অবস্থান কঠোর। তাদের এসব কর্মকাণ্ড বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এসব গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও ফৌজদারি মামলাসহ দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগ করা হবে। এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। অনেক কর্মকর্তাই বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে ভিওডি বাংলাকে বলেছেন, প্রশাসনের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করা আমাদের কর্তব্য। সরকারের দেওয়া নির্দেশ মোতাবেক ওপরের বসের আদেশ পালন করাই আমাদের কাজ। বরং অমান্য করাটা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অপরাধ। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসি অপরাধী হতে পারেন না। অপরাধ যদি হয়ে থাকে তা সেই সময়ের সরকার করেছে। আমরা আমাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কিছুই করিনি। যা করেছি সরকারের নির্দেশে করেছি। যা একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আমরা দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এর জন্য আমাদের শাস্তি দেওয়া এক ধরনের অবিচার, যা মানবতারও লংঘন বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ও বৈষম্যমূলকভাবে সাময়িক বরখাস্তের প্রতিবাদে এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফারুক দেওয়ান জানিয়েছেন, সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন ঢাকাতে সমাবেশের আয়োজন করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আলটিমেটাম দেয় এবং সে সময়ে ও পরবর্তী তারা অন্য ক্যাডারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি করেন। এর পূর্বে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘেরাও করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন কেউ কেউ। তার পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ২৫টি ক্যাডারের সদস্যদের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়।
তিনি জানিয়েছেন, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়াধীন দফতর বা সংস্থায় কর্মরত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মত প্রকাশের জন্য ঢালাওভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। কোনও কারণ দর্শানোর নোটিশ ব্যতিরেকে সামান্য অজুহাতে এ ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা মৌলিক অধিকার ও চাকরিবিধির পরিপন্থি। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এভাবে বরখাস্ত করায় পরিষদ সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
পরিষদ মনে করে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রত্যয় নিয়ে ছাত্রজনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করায় পরিষদ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস গঠনসহ বর্তমান সরকার যে সকল সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে পরিষদ। পরিষদ মনে করে, এভাবে সাময়িক বরখাস্ত অব্যাহত থাকলে সিভিল সার্ভিসে চরম অসন্তোষ দেখা দেবে, যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে। এমতাবস্থায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় হতে ইতোমধ্যে জারিকৃত সাময়িক বরখাস্তের আদেশসমূহ প্রত্যাহারপূর্বক অভিযোগ হতে অব্যাহতিদানের অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক এরূপ অন্যায় আগ্রাসনের বিষয়ে ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ ও সংশ্লিষ্ট ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে এবং এই অন্যায় আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এসব ঘটনায় সমগ্র প্রশাসনে চলছে নীরব স্থবিরতা। কাজে-কর্মে চলছে ঢিলেমি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের ডিসি, এসপিদের মধ্যে যারা বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্বপালন করেছেন, তাদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের মধ্যে কমপক্ষে একজনও স্বৈরাচারের বেআইনি আদেশ অমান্য করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। তা করলে আমরা উদাহরণ দিয়ে বলতে পারতাম। সুতরাং তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নেবে। আর নির্বাচনে বিতর্কিত ভূমিকার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা সবাই জানতে পারবেন।
এদিকে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার। আইনে অনমনীয় সব বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে বাতিল হওয়া কঠিন শাস্তির ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’ কার্যকর করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ ছিল। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেদিকে না গিয়ে বিদ্যমান ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় প্রশাসনে। নাজুক পরিস্থিতির সুযোগে দাবি-দাওয়া আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে সংকটে পড়ে প্রশাসন। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক কাজকর্ম। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় একটি অংশ এখনো কাজে অনুপস্থিত। রাতারাতি তাদের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছিল সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আইন সংশোধন করে কঠোর করার বিষয়টি সামনে আসে।
কর্মচারী আইন সংশোধন করে শৃঙ্খলাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর সংশোধিত আইনের অধ্যাদেশ জারি হলে মাত্র আটদিনের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়। এমন বিধান সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশে ছিল।
সম্প্রতি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আইন কঠোর করার পক্ষে মত দিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারাও। তবে ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাতে রাজি হননি।
আইন সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি) এ এন এম মঈনুল ইসলাম ভিওডি বাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব স্যারের এখতিয়ারাধীন।’
গণঅভ্যুত্থানের পর সুযোগ বুঝে অনেক সরকারি কর্মচারী কিছু অযৌক্তিক দাবি তুলে আন্দোলনে নামেন। সচিবালয়ের ভেতরে মিছিল হয়। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তোপের মুখে পড়তে হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন মোকাবিলায় নাজেহাল হতে হয় সরকারকে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া দেখান কর্মকর্তারা। তারা নিজের মধ্যে হাতাহাতিতেও জড়ান। সিনিয়র কর্মকর্তাদের দিকে তেড়ে যান। তখন এটা নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা করায় ১৭ জন উপসচিবকে শাস্তির সুপারিশ করে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি।
দাবি আদায়ে আনসারদের সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার কর্মসূচির মুখোমুখিও হতে হয় প্রশাসনকে। আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সচিবকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদের তোপের মুখেও পড়তে হয় তাকে।
এরপর উপসচিব পদে পদোন্নতির কোটা সংক্রান্ত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। উত্তাল হয়ে ওঠে প্রশাসন। কর্মবিরতি, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তা। সমাবেশ-সেমিনার করেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাও। নজিরবিহীনভাবে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে আক্রমণ করতে থাকে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়।
যদি ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানের আলোকে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করা হয়, তবে সেটি দরকার আছে। কারণ আমাদের মতো দেশে আমরা কোনো আইন, নিয়ম-কানুন মানতে চাই না। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝি না। এ রকম কড়াকড়ি দরকার আছে।- সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার
আন্দোলন-বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই সম্প্রতি ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’ ফের কার্যকর করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের বিদ্যমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নানা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে এবং কেউ কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আইনসঙ্গত আদেশ/নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পাদনে শৈথিল্য প্রদর্শিত হচ্ছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, আনুগত্য প্রতিষ্ঠা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহতকরণ এবং দ্রুত আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের ব্যবস্থা হিসেবে রহিত করা ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’ পুনরায় কার্যকর করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, অধ্যাদেশটি কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশের আদলে সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ কার্যকর করার পথে যায়নি। বরং বিশেষ বিধান অধ্যাদেশের কঠিন বিধান কর্মচারী আইনে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সরকারি কর্মচারীদের কোনো অপরাধের দ্রুত শাস্তি বিধানের জন্য কর্মচারী আইন কিংবা শৃঙ্খলা আপিল বিধিমালায় কোনো বিধান নেই। কোনো অভিযোগ উঠলে নানান প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি নিশ্চিতে কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর লেগে যায়।
সংশোধিত সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কার্যকলাপে লিপ্ত হন, যা সহকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে, অন্যদের কাজে বাধা দেয়; অনুমোদিত ছুটি বা বৈধ কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকে বা কর্তব্য পালন থেকে বিরত থাকে; অন্যদের কাজ থেকে বিরত থাকতে প্ররোচিত করে বা তাদের কর্তব্য পালনে বাধা দেয় এবং অন্যকে অফিসে যোগদান বা তাদের নির্ধারিত কাজ সম্পাদনে বাধা দেয়, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এসব অপরাধের জন্য প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বরখাস্ত, অপসারণ এবং পদাবনতি বা বেতন কমানো- এ তিন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তাকে অবহিত হওয়ার দুই থেকে পাঁচদিনের মধ্যে অভিযোগের জবাব দিতে হবে বা ব্যক্তিগতভাবে শুনানিতে উপস্থিত থাকতে হবে।
অভিযুক্ত কর্মচারী যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব দিতে ব্যর্থ হন বা জবাব দেওয়ার পরেও দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে কর্তৃপক্ষ শাস্তি নির্ধারণসহ তাকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিতে ব্যর্থ হন বা কর্তৃপক্ষের কাছে যদি জবাব সন্তোষজনক না হয়, তাহলে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। এমন বিধান ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশেও রয়েছে।
তবে খসড়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাতদিনের মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বা বিশেষ ক্ষেত্রে ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আপিলের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। তবে শাস্তির বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ বিশেষ বিধান অধ্যাদেশে ছিল না।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার ভিওডি বাংলাকে বলেন, ‘যদি ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানের আলোকে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করা হয়, তবে সেটি দরকার আছে। কারণ আমাদের মতো দেশে আমরা কোনো আইন, নিয়ম-কানুন মানতে চাই না। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝি না। নিজেরটা পাওয়ার জন্য আমরা যত রকমের আউট অব দ্য ওয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেজন্য এ রকম কড়াকড়ি দরকার আছে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানে আছে যে, প্রথম নোটিশ পাঁচদিন পরের নোটিশ তিন দিন। তাহলে আটদিন হয় (শাস্তি দিতে)। সেখানে তদন্তের দরকার নেই।’
‘এখন পুলিশের অনেকে কাজে অনুপস্থিত। এদের ধরার জন্য তো কোনো আইন নেই। এদের ধরার উপায় হলো ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান বা এমন কোনো আইন করা। এদের বিষয়টি সুরাহা করতে না পারলে নতুন লোকও নেওয়া যাবে না, আর যারা চাকরিতে আছেন তাদের মনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেন, ‘আইন প্রয়োগ করা মানেই কিন্তু শাস্তি দেওয়া নয়। মূল হলো বার্তা দেওয়া যে, আমরা কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নই।’
নাম প্রকাশ না করে একজন সাবেক সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ভিওডি বাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে শিক্ষা ক্যাডার বা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যা করলেন, প্রশাসন ক্যাডারের সচিবালয়ের বারান্দায় শুয়ে রইলেন- এগুলো তো কোনোভাবে মানা যায় না। শিক্ষা ও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। এমনটা কখনো হয়েছে বলে শুনিনি। এগুলোর অবশ্যই প্রতিকার হওয়া উচিত। এজন্য আইন কঠোর করার বিকল্প নেই।’
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ঈদুল আজহা
ইবি প্রতিনিধি
মুসলিমদের জন্য ঈদুল আজহা পরম আনন্দের একটি দিন। …

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তিন কর্মকর্তার সিন্ডিকেট
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার …

রাজপথই সমাধান দেখছে বিএনপি
মোক্তাদির হোসেন প্রান্তিক
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকেও আগামী জাতীয় সংসদ …
