রাখাইনে করিডরের শর্ত নিয়ে অস্পষ্টতা

ভিওডি বাংলা রিপোর্ট

মায়ানমারের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল রাখাইনে জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশের শর্তসাপেক্ষে ‘মানবিক করিডর’ সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানের সমালোচনা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে এ ধরণের সিদ্ধান্তে শঙ্কা জানিয়ে রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশকে ফিলিস্তিনের গাজার মতো পরিণতির দিকে ঠেলে না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মানবিক সহায়তার কথা বলে যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেটিই এখন দেশের জন্য সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হয়ে আছে। তার মাঝে আবারও ‘মানবিক করিডরের’ সুযোগ দিয়ে যদি নতুন সংকট তৈরি হয়, সেটা দেশের জন্য আরও বড় ক্ষতি হবে। তাই শর্ত সাপেক্ষে মানবিক করিডরের বিষয়গুলো জনগণের সামনে স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিস্কারের আহ্বান জনিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

‘শর্তসাপেক্ষে মানবিক করিডর নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে’ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমত, এ ব্যাপারে আমাদের কারও কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কী সেই শর্তগুলো? সেটা প্রকাশ করতে হবে, জনগণকে জানাতে হবে। কী বিষয়ে এবং কোন রুটে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের (বাংলাদেশের) জাতীয় স্বার্থ কী? এ বিষয়ে আমরা যারা এসব নিয়ে কাজ করি তারাও পরিষ্কার না।’

তিনি বলেন, ‘মায়ানমারের এই রাখাইন কোনো সাধারণ এলাকা নয়। এখানে চীন, রাশিয়া, আমেরিকাসহ বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা আছে। পাশাপাশি রাখাইনে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ-সংঘাত চলছে। তাহলে এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেখানে কেন যুক্ত হবে? এটা উদ্বেগের বিষয়।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এই করিডর কেন বা কী উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, সেটা পরিস্কার না। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ কী এবং জাতিসংঘের স্বার্থ কী- এগুলো পরিস্কার করা দরকার। হতে পারে, কক্সবাজার বিমানবন্দর ব্যবহার করে জাতিসংঘ রাখাইনে কোনো মানবিক সহায়তা বা ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়, তাহলে সেটা হতে পারে। কিন্তু করিডরের নামে সেখানে আরাকান আর্মি বা রাখাইনরা যদি বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ পায়, তাহলে তো দেশের জন্য ভালো কিছু হবে না।’

‘‘দেখতে হবে, ওই করিডরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট দূর হবে কি না। জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্বকারী যেসব দেশ আছে তারা এ বিষয়ে কী বলছে, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। দেখা গেল, এই করিডর সুবিধা দিতে গিয়ে রোহিঙ্গা সংকট ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট আরও বাড়ল, তখন কী হবে? তাদের (জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি) লড়াইয়ের মধ্যে আমরা যাতে কোনোভাবে যুক্ত হয়ে না যাই, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। উপদেষ্টা (পররাষ্ট্র) বলেছেন, ‘এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে না’, তাহলে আমরা কীভাবে জানব ওই করিডরে কী হবে? তাই সবার আগে করিডরের উদ্দেশ্য ও শর্তগুলো পরিষ্কার করা প্রয়োজন’’-বলেন ড. ইমতিয়াজ।

এদিকে সোমবার ২৮ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর করিডর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানের কড়া সমালোচনা করে বাংলাদেশকে গাজার মতো পরিণতির দিকে ঠেলে না দিতে সতর্ক করেছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে এ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।

মায়ানমারের জান্তা সরকার তথা সামরিক নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গা নাগরিকরা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থান করেন। বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ লাখ বলা হচ্ছে। যদিও রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখের বেশি, যা সে সময় বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা নানা কৌশলে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছেন বলেও অভিযোগ আছে।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বাইরে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে করিডর হলে তা ঠিক হবে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘মায়ানমার আমাদের কখনোই ভালোভাবে নেয়নি। এখন করিডর কিসের জন্য হবে? যদি । মূলত আমাদের উদ্দেশ্য হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। মায়ানমারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হলে এই করিডরের দরকার নেই।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা দিতে না পারা জাতিসংঘের সব কথা বাংলাদেশকে কেন শুনতে হবে, এই প্রশ্নও করেন ড. নাজনীন। তিনি বলেন, ‘‘সরকারের একজন উপদেষ্টা (পরররাষ্ট্র) বলছেন, ‘করিডর নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে না বা বলতে পারব না’- এই বিষয়টা তো আমাদের জন্য ভালো না। যেহেতু আমরা বলছি এটা গণতান্ত্রিক সরকার নয় এবং সব সময় জনগণকে জানিয়ে সবকিছু করতে হবে, গোপন করে কিছু করা যাবে না, তাহলে বিস্তারিত বলা যাবে না বা এই জাতীয় কথা কেন আসছে? আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত রোহিঙ্গারা যারা আমাদের দেশে ঢুকেছে, তাদের ফেরত পাঠানো। ‘

২০২১ সালে বেসামরিক সরকার উৎখাত করে মায়ানমারে সামরিক শাসন জারির পর থেকেই দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ বা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। জান্তাবিরোধী ‘থ্রি বাদারহুড অ্যালায়েন্সের’ একটি হলো ‘আরাকান আর্মি’। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আরাকান আর্মি জোট ব্যাপক হামলা শুরু করে। চীন সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে সশস্ত্র সংগঠনটি। গত আগস্টে এই জোট উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাসিও নিয়ন্ত্রণে নেয়।

বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মায়ানমারের একটি উপকূলীয় রাখাইন রাজ্য মূলত রোহিঙ্গা মুসলিমদের আবাসস্থল। জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর গত নভেম্বরে সেখানে লড়াই শুরু হয়েছিল। এর পর থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি একের পর এক জয় পেয়ে এখন পর্যন্ত রাখাইন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এমন প্রেক্ষাপটেও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে নানা রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুর দিকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এ জন্য গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ ‘করিডর’ দেওয়ার অনুরোধ করে। সেই প্রেক্ষাপটে গত রবিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে মায়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।

উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত বলছি না। সেই শর্তাবলি যদি পূরণ হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ করিডর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ হবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা, অস্ত্র নেওয়া হচ্ছে না।’

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ