ভাইরাল সান্ডার সাতকাহন


ফিচার ডেস্ক
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আজ কোনো ঘটনাই শুধু একটি দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। পুরো বিশ্ব যেন পরিণত হয়েছে একটি ‘ওপেন থিয়েটার’-এ। এই খোলা মঞ্চেই সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে এক অদ্ভুত প্রাণী—‘সান্ডা’। একটি নিরীহ মরু প্রাণী এখন ভিডিও, রম্যকথা, হাস্যরসাত্মক পোস্ট ও মিমের মূল বিষয়বস্তু।
সান্ডা আসলে কী?
সান্ডা হলো একটি টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Uromastyx। এটি দেখতে অনেকটা গুইসাপের মতো হলেও এর শরীর তুলনামূলক ছোট এবং এর মোটা। এর খাঁজযুক্ত লেজ আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রাণীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়—‘মাস্টিগুর’, ‘সান্ডা টিকটিকি’, কিংবা ‘কাঁটা লেজযুক্ত টিকটিকি’।
মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে এই প্রাণীটির আবাস। এটি তৃণভোজী, অর্থাৎ গাছপালা, ফুল ও বীজ খেয়ে জীবনধারণ করে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পোকামাকড়ও খেতে দেখা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ‘সান্ডা শিকার’ এবং ভাইরাল ট্রেন্ড
সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ‘সান্ডা শিকার’ একটি জনপ্রিয় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, মরুর বালির মধ্যে প্রবাসীরা দৌড়ে বেড়াচ্ছেন সান্ডা ধরতে। কেউ বলছেন, “ভাই, এই সান্ডা না ধরতে পারলে চাকরি যাবে”, আবার কেউ বলছেন, “কফিল বলেছে, সান্ডা না পেলে ভিসা ক্যানসেল।” এই ভিডিওগুলোতে যে কৌতুকের ছোঁয়া আছে, তা সত্যি—কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব জীবনের গল্পও।
এই ভিডিও ও মিমগুলো বাংলাদেশে পৌঁছেই ভাইরাল হয়ে গেছে। অনেকে মজা করে বলছেন, “বৈধ ভিসার চাবিকাঠি নাকি এখন এক টিকটিকি!” ফলে সান্ডা হয়ে উঠেছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ট্রেন্ডের কেন্দ্রবিন্দু, যা শুধু রম্য নয়, বরং প্রবাসীদের জীবনযাত্রার এক প্রতীকও।
এ ছাড়াও ফেইসবুক জুড়ে এখন আলোচনা, ঠাট্টা আর ইয়ার্কির বিষয় এই সান্ডার বিরিয়ানি। বেশ কয়দিন ধরেই ফেইসবুকের ট্রেন্ড হলো ‘সান্ডা’। এই সামাজিক যোগাযোগে দুই-তিন মিনিট রিলস-এ চোখ রাখলেই অন্তত ৪-৫টি ‘সান্ডা’র কন্টেন্ট-এর দেখা মিলে যাবে।
সান্ডা তেল: বাস্তবতা ও ভ্রান্তি
সান্ডা নিয়ে জনপ্রিয় আরেকটি বিশ্বাস হলো ‘সান্ডা তেল’। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত এই তেলকে অনেকে যৌন শক্তি বৃদ্ধির উপাদান হিসেবে প্রচার করে থাকেন। যদিও বিজ্ঞানসম্মতভাবে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়, তবুও বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কিছু আঞ্চলিক হাটে এই তেল বিক্রি হতে দেখা যায়।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সান্ডা
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনো সান্ডা খাননি, তবে এটি খেতে অন্যকে নিষেধও করেননি। তাই অনেক আলেম এটিকে মাকরুহ বলে বিবেচনা করেন। তবে হানাফি মাজহাবে এটি খাওয়া হারাম হিসেবে ধরা হয়। অন্য মাজহাবগুলোতে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত
বাংলাদেশে এই ভাইরাল ট্রেন্ড ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে নিছক হাস্যরসের অংশ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ বলছেন এটি অশোভন এবং বাংলাদেশি প্রবাসীদের মর্যাদাহানি করছে। অনেকেই বলছেন, এই ভিডিওগুলো প্রবাসী জীবনের কষ্টের প্রতীক, যা তারা মিমের ভাষায় প্রকাশ করছেন।
সামান্য মরুর প্রাণী—নাম সান্ডা। যাকে হয়তো বহু মানুষ চিনতোই না, সেটি এখন ভাইরাল। তবে শুধু প্রাণী নয় হিসেবে ভাইরাল নয়, সে এখন একধরনের ‘প্রতীক’—প্রবাসী জীবনের হাস্য-কান্না, কষ্ট আর কৌতুকের প্রকাশ।
আমরা হেসে উঠি ভিডিও দেখে, কিন্তু যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি—সেখানে লুকিয়ে আছে এক দল মানুষের বাস্তবতা। যারা মরুভূমির গরমে, দূর দেশে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, চাকরি বাঁচাতে টিকটিকি ধরাও তাদের জন্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই দুনিয়ায় আমরা যা দেখি, তা শুধু বিনোদন নয়—তা মানুষের জীবন থেকে উঠে আসা গল্প। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো বিষয় নিয়ে মজা বা আলোচনা করার সময় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন শ্রদ্ধাশীল এবং মানবিক হয়।
ভিওডি বাংলা/ডিআর