• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী জিয়াউর রহমান

   ৩০ মে ২০২৫, ০৩:২০ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

শায়রুল কবির খান

দিনটি ছিল শুক্রবার, ১৯৮১ সাল ২৯ মে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা করলেন, বিএনপির সাংগঠনিক বিরোধ নিরসনের লক্ষ্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম গিয়েছিলেন। জুমার নামাজের আগেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বৈঠকে বসেন। নামাজের ও খাবারের বিরতি বাদে বৈঠক অব্যাহত থাকে। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত ছিল রাতেই ঢাকায় ফেরা। কিন্তু কে জানতো, ওই রাতে বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে এক অমানিশা আঘাত নিয়ে আসবে।

আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল, সিদ্ধান্ত হলো প্রেসিডেন্ট রাত্রীযাপন করবেন। স্ত্রী ও সন্তানের সাথে কথা বলে সফরসঙ্গী ও সিনিয়র নেতাদের সাথে আবারো বৈঠকে বসলেন। ভোর রাতে অর্থাৎ ৩০ মে ১৯৮১ সবচেয়ে জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য বিচক্ষণ, সততা ও বাস্তববাদী রাষ্ট্রপতিকে একদল উচ্ছৃঙ্খল সামরিক অফিসার হত্যা করলেন। তিনি শহীদ হলেন; বাংলাদেশ থমকে দাঁড়াল, কাঁদল জনগণ শিশু যুবক বৃদ্ধসহ আপামর। তার মৃত্যুশোকে যেন ভারাক্রান্ত ছিল প্রাণপ্রকৃতিও।

ওই রাতের দীর্ঘ বৈঠকে আলোচনায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তিনটি কথা সবচেয়ে সহকারে জোরালভাবে বলেছেন, সততা, শৃঙ্খলা ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া এই দেশ এই জাতি ও এই দল দাঁড়াবে না। আপনার যদি সব দিতে না পারেন অন্তত আপনারা শুধু আমাকে শৃঙ্খলা দেন, বাকি সব আমরা করব।

এই তিনটি শব্দ তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। পরিহাস্য, আজও আমাদের পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় অভাব শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ। যার মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ নেই তার মধ্যে নীতিবোধও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

দেশে অন্তর্বর্তী সরকার। কারো কোনো কথা নেই, কারো মধ্যে কোনো পরামর্শ নেই, যৌক্তিক মতামত নেই, যখন-তখন কোনো না কোনো ইস্যুতে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে, যখন প্রয়োজন শৃঙ্খলা বোধ, তখন তার অভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ছাত্র-শ্রমিক জনতার গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে গেছেন বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যসহ প্রায় সকল মন্ত্রী এমপি ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগসহ তাদের নেতাদের বিচার না হওয়ার পর্যন্ত সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। আওয়ামী লীগের অপরিণামদর্শী বাড়াবাড়ির ফলে কতটা নির্মম পরিনতির শিকার হতে হল। আজ ও আগামী দিনের রাজনীতিকদের জন্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলক বার্তা।

রাজনীতিকদের মধ্যে আবেগ ও বাস্তবতার একটা যৌক্তিক সমন্বয় দরকার। আবেগ দিয়ে সৃষ্টি করা যায় কিন্তু রক্ষা করা যায় না। রক্ষা করতে হলে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। আবেগের সাথে বাস্তবতার তফাৎ ও দুরত্ব অনেক। বাস্তবতার ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিতে পারলে যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করা যায় না, এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কঠিন হয়।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সবার চেয়ে ব্যতিক্রম, তাই তার সাথে অন্য কাউকে তুলনা করা যায় না। তিনি সবসময় সবগুলো বাস্তবতার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর তাই তো আজও বিএনপি এত শক্তিশালী। আওয়ামী দুঃশাসনের সময় শত নিপীড়ন নির্যাতনেও সামান্য পরিমাণ ক্ষতি হয়নি। ১৬-১৭ বছরে দমন-পীড়নেও ১৬-১৭-টি ধানের মধ্যে পোকা ধরেনি।

শহীদ জিয়াউর রহমানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদক্ষেপ তুলে ধরতে চাই। জিয়াউর রহমান কথিত সমাজতান্ত্রিক নীতি কৌশল থেকে সরে এসে অর্থনীতি, শিল্পনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতিপদ্ধতির মাঝামাঝি একটা মধ্যপন্থী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করেছিলেন। সেসময় গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল নাগরিক সেবাকে সরকারি খাতে রেখেই বেসরকারি শিল্প বিকাশের পথে কার্যকরভাবে হাঁটা শুরু করেন। দ্রুততার সাথে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব শিক্ষায় গণশিক্ষা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও বেসরকারি খাতে শিল্প উৎপাদন।

এসময় সম্পূর্ণভাবে নতুন দু’টি শ্রমবাজার তৈরি হয়। প্রথমত, তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমবাজার। এর বাইরেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি- ‘একটি সন্তান হলে দু’টি নয়, দু’টি সন্তান হলে আর নয়, দু’টি সন্তান সুখী পরিবার।’

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার তাড়নায় নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি স্রোতের মত নগরে বিশেষ করে ঢাকায় ছুটে এসেছেন যাদের অনেকেই পরে গ্রামে ফিরে যাননি। গ্রামে ও শহরে লস শ্রমঘন বেকারত্বকে শ্রমবাজারে রূপান্তর করেন। অলস শ্রমকে করে তোলেন উৎপাদনমুখী। খাল খনন করে সেচের সুবিধা তৈরির ফলে কৃষিতে সবুজবিপ্লব আসে। প্রায়োগিক পুঁজি ও মানবপুঁজি উভয়ের বহুবিধবিকাশ শুরু হয়।

জনশক্তি রফতানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যের রফতানির দ্বার উন্মোচিত হয়। ফলস্বরূপ শহীদ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের মাঝের ও শেষ এই দু’টি অর্থবছরে (১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮০-৮১) বাংলাদেশ সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।

জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন গড়ে ৪.৫২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, যা নব্বই দশকের আগের সময়ে গড় হিসেবে সর্বোচ্চ। (সূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক)

বহুমুখী বাস্তবধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন জিয়াউর রহমান। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-কে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করেন। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ।

গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীও শুরু হয় তার আমলেই। বেতার-টিভির আধুনিক সম্প্রসারণ, দক্ষিণ এশিয়া সর্ব প্রথম বাংলাদেশে টিভির রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন করে তার সরকার।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা। চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন। ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন, বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ প্রতিষ্ঠা হয় তার সরকারের সময়ে। যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ঘটে জিয়াউর রহমানের সরকারের হাতে।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ বিনিয়োগে বাংলাদেশে প্রথম রফকানিযোগ্য তৈরি পোশাকশিল্প (বস্ত্রশিল্প) প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টসের যাত্রা। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু (পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে অধ্যাদেশ) হয়।

১৯৮০ সালে ডিসেম্বর মাসে ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হয়। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়।

সরকারি আলিয়া মাদরাসায় সিলেবাস আধুনিকীকরণ হয় জিয়াউর রহমানের সরকারের সময়ে। ইংরেজী, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিলেবাসে। শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিশু শারীরিক ও মনোবিকাশে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মানের শিশু পার্ক নির্মাণ করা হয়। দুঃখজনক, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার সেই পার্কটিকে বন্ধ করে পুননির্মাণের নামে, যা আজও চলমান রয়েছে। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারও উদাসীনতা দেখাচ্ছে পার্কটি চালু করতে।

১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর সরকারি কর্মকমিশন সংস্কার করে বিসিএস-এ ১৪-টি বিশেষায়িত ক্যাডার সার্ভিস চালু করেন জিয়াউর রহমান যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। পল্লী চিকিৎসা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করেন গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রায় সকল ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী রাষ্ট্রপতি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কৌশলের পাশাপাশি পরিবর্তিত পররাষ্ট্র নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যমুখী বিদেশনীতি দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে দেশের অর্থনীতি পররাষ্ট্র নীতি ও সামরিক নীতি সংহতকরণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। অত্যন্ত স্বল্পসময়ে রাষ্ট্রগঠনে সর্বমুখী তৎপরতার জনক ছিলেন দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে ‘স্টেটসম্যানশিপ’ বা রাষ্ট্রনায়কোচিত অন্যতম প্রধান এই রাজনীতিবিদ শহীদ রাষ্ট্রপতি।

এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার। ২০২২ সালে ঘোষিত ৩১ দফার ভিত্তিতে আরো সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এটাই জনআকাঙ্ক্ষা আর নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা।

লেখক : বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ/এমপি

[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়] 

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
কার স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের তুলে দিতে হবে ?
কার স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের তুলে দিতে হবে ?
জুলাই বিপ্লবের পোষ্ট মর্টেম: ছাত্র-বিএনপি নাকি সবার!
জুলাই বিপ্লবের পোষ্ট মর্টেম: ছাত্র-বিএনপি নাকি সবার!
‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাম্য নয়'
‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাম্য নয়'