আরাফার দিবস ও আমাদের করনীয়


শাইখ ড. আবু তাহের
সিয়াম এমন এক ইবাদত—যা ধৈর্য, তাকওয়া ও আত্মসংযমের এক অভূতপূর্ব প্রশিক্ষণ। সিয়াম যেমন রমাদান মাসে ফরজ, তেমনি বছরের বিভিন্ন সময়ে কিছু নফল সিয়াম রয়েছে, যেগুলোর ফজিলত অপরিসীম। এর মধ্যে অন্যতম হলো আরাফার দিনের সিয়াম, যা মুমিন জীবনে একটি স্বর্ণালী সুযোগ। এই দিনটির সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা একটি অতীত এবং একটি আগত বছর—এই দুই বছরের গুনাহ মোচনের ওয়াদা করেছেন।
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الأَنْصَارِيِّ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ عَرَفَةَ، فَقَالَ:
«يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ»
[সহীহ মুসলিম, হাদীস: 1162]
বাংলা অনুবাদ:
আবু কাতাদা আল-আনসারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ কে আরাফার দিনের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:
“এটি আগের বছরের ও পরের বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা (মোচনকারী)।”
ব্যাখা
এখানে “يُكَفِّرُ” শব্দের অর্থ—মুছাফফি বা মোচনকারী। ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ), ইবনু হাজর আসকালানী (রহ.) সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেন—এই হাদীসে ছোট গুনাহসমূহ মোচনের কথা বোঝানো হয়েছে, কারণ তাওবাহ ছাড়া বড় গুনাহ ক্ষমা হয় না।
আরাফার সিয়াম : স্থাননির্ভর না সময়নির্ভর
ইসলামে আরাফার দিবসে রোযা রাখা একটি অতি ফজিলতপূর্ণ আমল। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
> "يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ"
“আরাফার দিনের রোযা গত বছরের ও আগামী বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।”
[সহীহ মুসলিম: ১১৬২]
তবে প্রশ্ন হলো—এই “আরাফার দিন” ঠিক কোন দিন? এটা কি স্থাননির্ভর অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব চাঁদ দেখে নির্ধারিত ৯ জিলহজ? নাকি সময়নির্ভর অর্থাৎ যেদিন হাজীগণ আরাফায় অবস্থান করেন, সেই দিন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম ও গবেষকগণের মধ্যে কিছুটা মতভেদ দেখা যায়। আমাদের এই প্রবন্ধে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে।
আরাফার সিয়ামের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
> “صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ”
“আরাফার দিনের রোযা, আমি আশা করি, এটি আগের বছরের ও পরের বছরের গুনাহ মোচন করে দেবে।”
[সহীহ মুসলিম: ১১৬২]
এ রোযাটি শুধু হজে না যাওয়া সাধারণ মুসলিমদের জন্য, কারণ হাজীদের জন্য রাসূল ﷺ রোযা রাখেননি।
[সহীহ বুখারি: ১৯৮৯; মুসলিম: ১১২৩]
মতভেদ ও দ্বিমত: কোন দিন সিয়াম?
প্রথম মত: স্থাননির্ভর (স্থানীয় চাঁদ দেখে ৯ জিলহজ)
দলীলসমূহ:
১. নবী ﷺ বলেছেন:
"صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ"
“তোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু করো ও চাঁদ দেখে ঈদ করো।”
[সহীহ বুখারী: ১৯০৯, মুসলিম: ১০৮১]
এতে প্রমাণিত হয়, ইবাদতের তারিখ স্থানভেদে পরিবর্তিত হতে পারে, যেমন রমাযান, ঈদ, আরাফা।
২. আরাফার রোযাও একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ৯ জিলহজে তা পালন হবে, যা ভৌগলিক ভিন্নতার কারণে পৃথক হতে পারে।
৩. ইবনে উথাইমিন (রহ.) বলেন:
“আরাফার রোযা হলো যেদিন মানুষ নিজেদের ৯ জিলহজ মনে করে।”
[আশ-শারহুল মুমতি’, ৬/৪৬০]
দ্বিতীয় মত: সময়নির্ভর (হজের আরাফার দিন)
দলীলসমূহ:
১. হাদীসে বলা হয়েছে:
"صيام يوم عرفة"
অর্থাৎ “আরাফার দিন”—এখানে আরাফা মানে আরাফার ময়দান, নির্দিষ্ট স্থান ও নির্দিষ্ট কার্যক্রমের দিন।
২. আরাফা একটি ঐতিহাসিক ও স্থানিক ঘটনাবিশেষ (হজের অন্যতম রোকন)। সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য এই দিনটি নির্ধারিত হয় হাজীদের আরাফায় উপস্থিতির ভিত্তিতে।
৩. আবু কাতাদাহ (রাঃ) হাদীসে স্পষ্ট এসেছে, "يوم عرفة" বলতে সেটাই বোঝানো হয়েছে যেদিন হাজীগণ আরাফায় অবস্থান করেন।
[সহীহ মুসলিম: ১১৬২]
৪. ইবনু আবী শাইবা (৩/৯৮, হা: ৭৭৭৪) ও অন্যান্য সূত্রে বর্ণিত—সাহাবীরা যখন জানতে পারতেন যে হাজীরা আরাফায় অবস্থান করছেন, তখন তারা সেদিন রোযা রাখতেন।
৫. যদি কেউ নিজস্ব চাঁদ অনুসরণ করে ভুলবশত ঈদের দিন রোযা রাখে, তবে সেটা হারাম। কিন্তু হাজীদের আরাফার দিন অনুসরণ করলে এমন বিপদের আশঙ্কা থাকে না।
৬. বর্তমান বিশ্বে সৌদি আরবই হজের কেন্দ্র, এবং তাদের নির্ধারিত দিনেই আরাফার কার্যক্রম হয়। একারণে সেদিনই ‘يوم عرفة’ হিসেবে ধরা যুক্তিযুক্ত।
বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
হাদীসগুলোতে ‘يوم عرفة’ বলতে একটি নির্দিষ্ট দিনকে বোঝানো হয়েছে, স্থানভেদে নয়। হজ একটি নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট স্থানকেন্দ্রিক ইবাদত। তাই "আরাফা" দিনটিও একইভাবে নির্দিষ্ট।
রমাযান বা ঈদের মত ইবাদতের স্থানভেদ হলেও, আরাফার দিনটি একটি ভৌগোলিকভাবে নির্ধারিত ঐক্যবদ্ধ দিন, যা পরিবর্তনশীল নয়।
অতএব, হাজিরা যখন আরাফায় অবস্থান করেন—সেই দিনই বিশ্বের সকল মুসলিমের জন্য "يوم عرفة", এবং সেই দিন রোযা রাখাই হাদীসের প্রকৃত উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সিদ্ধান্ত
আরাফার রোযা স্থাননির্ভর নয়, সময়নির্ভর। তবে এ সময় নির্ধারিত হবে—হাজীদের আরাফায় অবস্থানের দিন অনুযায়ী।
কারণ, হাদীসে “يوم عرفة” দ্বারা হজের নির্দিষ্ট কার্যক্রমের দিন বোঝানো হয়েছে। একমাত্র একটি স্থানেই হজ হয়—মক্কা। তাই “আরাফার দিন”ও একটি সময়েই হয়। সাহাবীদের আমল এবং সালাফগণের ব্যাখ্যা থেকেও এই দিকটি সমর্থিত।
সুতরাং, রোযা রাখা উচিত যেদিন হজের আরাফার দিন পড়ে, স্থানীয় ৯ জিলহজ হিসাব করে নয়।
এই ইখতিলাফপূর্ণ বিষয়ে উলামাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও—সাবধানতার পথ হল, হাজীদের আরাফার দিনেই রোযা পালন করা। কেননা যদি কেউ স্থানীয় হিসেবে ভুল করে ঈদের দিন রোযা রাখে, তবে সেটা হারাম। পক্ষান্তরে হজের আরাফার দিন রোযা রাখলে সর্বোচ্চ কোনো ফযীলত হাতছাড়া হলেও গুনাহ হবে না।
ভিওডি বাংলা/ডিআর