ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে কুরবানীর পশু


শাইখ ড. আবু তাহের
কুরবানী কেবল এক উৎসব নয়—এটি তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ, আত্মত্যাগের প্রতীক এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক মহান ইবাদত। আর এই ইবাদতে ব্যবহৃত পশুটিও হতে হবে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপযুক্ত। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে কুরবানিতে ‘শ্রেষ্ঠ’ উৎসর্গ করার শিক্ষা। কিন্তু কেন কিছু পশু কুরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়? কেন একচোখো, দুর্বল, ল্যাংড়া বা রোগাক্রান্ত পশু কুরবানির উপযোগী নয়?
এই প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজব দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে। ইসলামের বিধান এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও পশু-স্বাস্থ্যবিদ্যার আলোকে।
হাদীস:
قال رسول الله ﷺ:
"أربعة لا تجوز في الأضاحي: العوراء البين عورها، والمريضة البين مرضها، والعرجاء البين ضلعها، والعجفاء التي لا تنقي."
“চার প্রকার পশু কুরবানিতে গ্রহণযোগ্য নয়—যার এক চোখ অন্ধ ও তা স্পষ্ট, যে পশু গুরুতরভাবে অসুস্থ, যে পশু পা টেনে চলে, এবং যে পশু এতই দুর্বল যে তার হাড়ে মজ্জাও নেই।”
[সুনান আবু দাউদ: ২৮০২, তিরমিযী: ১৪৯৭ – হাসান সহীহ]
হাদীসের শব্দ ও অর্থ বিশ্লেষণ:
আরবি শব্দ অর্থ ব্যাখ্যা
أربعٌ চারটি চার প্রকার পশু দোষ
لا تجوزُ বৈধ নয় শরীয়তসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়
العوراءُ একচোখা চোখ অন্ধ, যা চোখে পড়ে
المريضةُ রোগাক্রান্ত জ্বর, ক্ষয়, সংক্রামক রোগ যুক্ত
العرجاءُ ল্যাংড়া খোঁড়ানো স্পষ্ট
العجفاءُ কঙ্কালসার এত দুর্বল যে হাড়ে মজ্জা নেই
ইসলামি ব্যাখ্যা:
১. তাকওয়ার প্রকৃত প্রকাশ
> "لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ"
“আল্লাহর নিকট তাদের মাংস ও রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
[সূরা হাজ্জ: ৩৭]
কুরবানী হচ্ছে হৃদয়ের তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। অন্ধ, ল্যাংড়া বা রোগাক্রান্ত পশু উৎসর্গ করা আল্লাহর সম্মুখে অবহেলার প্রতীক।
২. উৎসর্গের উৎকৃষ্টতা
"لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ"
“তোমরা কখনোই পূর্ণ নেকি লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় করো।”
[সূরা আলে ইমরান: ৯২]
আল্লাহর পথে উৎসর্গ তখনই মূল্যবান হয়, যখন তা হৃদয়ের প্রিয় ও উৎকৃষ্ট জিনিস হয়।
৩. গরীবদের উপকার নিশ্চিত করা
কুরবানির মাংস গরীব-মিসকিনের মুখে হাসি ফোটায়। যদি মাংস অনুপযোগী হয় (অসুস্থ, কঙ্কালসার পশুর কারণে), তা হবে গরীবের প্রতি অবিচার।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:
১. অন্ধ পশু (العوراء)
চোখে ইনফেকশন, ভাইরাস বা জন্মগত ত্রুটি থাকা পশু সাধারণত সংক্রমণ-প্রবণ হয়। এর মাংস সংরক্ষণ ও খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
২. রোগাক্রান্ত পশু (المريضة)
যেমন: Brucellosis, Foot-and-Mouth Disease, Anthrax ইত্যাদি রোগ মানুষেও সংক্রমিত হয়।
অসুস্থ পশুর রক্ত ও মাংসে জীবাণু থাকে — যা মানবদেহে মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
৩. ল্যাংড়া পশু (العرجاء)
ইনফ্ল্যামেশন, পেশি দুর্বলতা, আর্থ্রাইটিস, বা স্নায়ু সমস্যা — এগুলোর পরিচায়ক। এই পশু কষ্ট পায়, ছটফট করে — যা পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা।
৪. চরম দুর্বল পশু (العجفاء)
পরজীবী (worms), দীর্ঘ রোগ বা অপুষ্টিতে আক্রান্ত পশুর হাড়ে চর্বি থাকে না। এর মাংস ঝুঁকিপূর্ণ, স্বাদহীন ও দ্রুত পচনশীল।
তুলনামূলক উপস্থাপনা:
ইসলামি কারণ
তাকওয়ার পূর্ণতা চাওয়া
উৎকৃষ্ট উৎসর্গের শিক্ষা
গরীবদের উপকার
বৈজ্ঞানিক কারণ
সংক্রমণ প্রতিরোধ ও খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টিহীনতা ও রোগ ঝুঁকি প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ।
ইসলামের প্রতিটি বিধান যেমন আত্মিকভাবে মানুষকে শুদ্ধ করে, তেমনি তা বাস্তব জীবনে আনয়ন করে উপকারিতা, নিরাপত্তা ও কল্যাণ।
রাসূল ﷺ যে চার শ্রেণির পশু কুরবানির জন্য নিষিদ্ধ করেছেন — তা শুধু তাকওয়া ও ইবাদতের পরিপূর্ণতার জন্য নয়, বরং মানবিকতা, পশু কল্যাণ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত সময়োচিত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নির্দেশ।
সুতরাং, সুস্থ, সুন্দর ও দোষমুক্ত পশু কুরবানিই— একজন মুমিনের তাকওয়া, সচেতনতা ও দয়াশীলতার পরিচায়ক।
ভিওডি বাংলা/ডিআর