ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হামলা, বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে বিশ্ব


অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে যাওয়া ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’কে হামলা চালিয়ে ভণ্ডুল করেছে ইসরায়েল।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) গভীর রাতে ভূমধ্যসাগরে এ বহরে ‘শায়েতেত ১৩’ নৌ কমান্ডো ইউনিট জলদস্যুতার মতো হামলা চালায়। একটি ছাড়া প্রায় সব জাহাজ কবজায় নিয়ে শত শত মানবাধিকারকর্মীকে আটক করে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিশ্বের ৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ নাগরিক ছিলেন ওই বহরে। ত্রাণবাহী শান্তিপূর্ণ বহরে মুখ বেঁধে ইসরাইলি নৌবাহিনীর জলকামান হামলা-আটকের ফুটেজ ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা বিশ্ব। রাজধানী মাদ্রিদ-বোগোটায় রাতেই বিক্ষোভে নামেন স্পেন-কলম্বোর নাগরিকরা। হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা আর মুখে ইসরাইলবিদ্বেষী স্লোগানে বিক্ষোভ হয় ফ্রান্স, তুরস্ক, পাকিস্তান, জার্মানি, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, তিউনিশিয়া ও গ্রিসের রাজধানী শহরগুলোয়।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিশ্বনেতারাও। ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে স্পেন ও বেলজিয়াম। আরও এক ধাপ এগিয়ে তাৎক্ষণিক দেশটির রাষ্ট্রদূত বহিষ্কার করেছে কলম্বো। আলজাজিরা, রয়টার্স, সিএনএন, বিবিসি, এএফপি।
শহীদ আবরারের দেখানো পথে জুলাই বিপ্লব হয়েছে শহীদ আবরারের দেখানো পথে জুলাই বিপ্লব হয়েছে
ইসরাইলি ধৃষ্টতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলেও ফুঁসে উঠেছে তুরস্ক। ইসরাইলবিরোধী বড় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ইস্তাম্বুলের রাজপথ। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানও।
এক বিবৃতিতে বলেছেন, গাজায় ত্রাণবাহী জাহাজ আটকে দেওয়া ‘জলদস্যুতার কাজ’। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলের হস্তক্ষেপকে ‘সন্ত্রাসবাদের কাজ’ বলে অভিহিত করেছে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে বলেও জানিয়েছে আঙ্কারা।
ফ্লোটিলায় আটক মালয়েশিয়ার নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘ইসরাইল শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের মৌলিক অধিকারকে উপেক্ষা করছে না, বরং বিশ্বসম্প্রদায়ের বিবেককেও পদদলিত করছে। ইসরাইলকে জবাবদিহির জন্য সব আইনানুগ ও ভিত্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ইসরাইল তাকে আশ্বস্ত করেছে নৌবহরের বিরুদ্ধে ‘কোনো সহিংস পদক্ষেপ’ নেওয়া হবে না। এমনকি গাজার সঙ্গে সংহতি দেখাতে ইতালিয় ইউনিয়নগুলো আলাদাভাবে আজ সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে।’
ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েলি সরকারের সামরিক কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে ব্রাজিল। কেননা বিষয়টি অধিকারের লঙ্ঘন এবং শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদকারীদের শারীরিক নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে। ফ্লোটিলা বহর থেকে আটক ব্রাজিলের ১৫ নাগরিকের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটির সরকার।’
এদিন ভোরেই এক পোস্টে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জানিয়েছেন, ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে পাকিস্তান।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি, যারা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে অবৈধভাবে আটক হয়েছে, তাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। তাদের ‘অপরাধ’ ছিল নিরুপায় ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। এই বর্বরতা অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। শান্তি তৈরির একটি সুযোগ দেওয়া উচিত এবং মানবিক সাহায্য তাদের কাছে পৌঁছানো উচিত, যা তাদের সত্যিই প্রয়োজন ‘
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলকে অনুরোধ করেছে-তারা ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া ফরাসি নাগরিকদের কনস্যুলার সেবা প্রদান করুক এবং অযথা বিলম্ব না করে ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিক।’
অধিকারকর্মীদের আটকের প্রতিবাদে মাদ্রিদে নিযুক্ত ইসরাইলের শীর্ষ কূটনীতিককে তলব করেছে স্পেন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেজ বলেছেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) মাদ্রিদে অবস্থিত ইসরায়েলের চার্জ দি অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছি। ত্রাণবহরটিতে স্পেনের ৬৫ জন নাগরিক রয়েছেন।’
আটকের ঘটনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে নিন্দা জানিয়ে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে বেলজিয়ামও।
ফ্লোটিলার ওপর ইসরায়েলের ‘আক্রমণ ও আগ্রাসনের’ নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ফিলিস্তিনের জলসীমার ওপর ইসরাইলের কোনো কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব নেই। আটক সব কর্মীকে অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে যুদ্ধ বন্ধের মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার।
যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মুক্তি দিতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় গ্রিন পার্টিও।
ইসরায়েলি অবরোধ উপেক্ষা করে ৩১ আগস্ট স্পেনের বন্দর থেকে খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রীতে পূর্ণ ৫০টিরও বেশি জাহাজ নিয়ে গাজার অভিমুখে এগোচ্ছিল বিশাল ফ্লোটিলা। ছুটে যাচ্ছিলেন অবরুদ্ধ উপকূলের ক্ষুধার্ত বাসিন্দাদের দিকে। কিন্তু বুধবার মধ্যরাতে গাজা থেকে মাত্র ৭০-৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকতেই নেমে আসে দখলদার শক্তির ছায়া। বহরের প্রথম জাহাজ আলমাতে উঠে পড়ে ইসরাইলি নৌ সেনারা। রাতেই সুমুদ ফ্লোটিলার কয়েকটি নৌযান জব্দ করে তারা।
এরপর একে একে প্রায় সব জাহাজেরই নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শেষ চেষ্টা চালালেও গাজার খুব কাছে গিয়েও উপকূলে পৌঁছানোর আগেই থেমে গেল ১৮ বছরের অবরোধ ভাঙতে বিশ্বমানবতার আশা ও প্রতিবাদের নৌযাত্রা। টানা ৩৩ দিনের প্রাণপণ চেষ্টায়ও ভাঙা গেলো না গাজার শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধ!
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদিন এক এক্স বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘গাজায় পৌঁছানোর আগেই বৃহস্পতিবার ফ্লোটিলার যাত্রা শেষ হয়েছে। সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করা বা আইনসম্মত নৌ-অবরোধ লঙ্ঘন করার চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।’ তবে একটি জাহাজ এখনো সমুদ্রে অবস্থান করছে বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।
মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, ‘আরেকটি জাহাজ রয়েছে। সেই জাহাজ যদি যুদ্ধাঞ্চলে প্রবেশ করে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করে, তবে সেটিকেও আটক করা হবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জাহাজের সব যাত্রী নিরাপদ এবং সুস্থ আছেন। তাদের নিরাপদে ইসরাইলের আশদোদ বন্দরে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে একই দিনে নতুন করে গাজা সিটি ঘিরে ফেলেছে ইসরায়েলি সেনারা। শহরে প্রবেশের প্রধান সড়কগুলো বন্ধ করে দিয়েছে তারা। ভোর থেকে বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৫ ফিলিস্তিনি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার ২২৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩৮ জন আহত হয়েছেন।
ভিওডি বাংলা/জা