আটজনে জিম্মি নার্সিং সেক্টর

আটজনের হাতে জিম্মি দেশের নার্সিং সেক্টর। যারা নার্সিং খাতের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো খাতটি জিম্মি করে রেখেছেন। বিগত সরকারের আমলে এই গ্রুপটি নার্সদের বদলি-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেও একই গ্রুপ একই ধারা বজায় রেখেছে। চক্রটি এখনো হজ টিমের তালিকায় নার্সের নাম অন্তর্ভুক্তি, বিদেশে উচ্চশিক্ষা, পদোন্নতি এবং নার্সদের বিভিন্ন কলেজ/ইনস্টিটিউটে পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করছে।
সাধারণ নিয়মে বদলির আবেদন করলে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও কোনো ফল পাওয়া যায় না, অথচ এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নিমেষেই বদলির আদেশ হয়ে যায়—এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
এসব বিষয়ে গত ১৫ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ন্যাব) দপ্তর সম্পাদক এস এম শুভ আহমেদ। অভিযোগপত্রটি আমলে নিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে মহাপরিচালককে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সহকারী সচিব (নার্সিং সেবা-২) মো. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত আদেশে এসব নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা হলেন—জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র স্টাফ নার্স মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (জুয়েল), জাতীয় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. শরিফুল ইসলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ফারুক হোসাইন, চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স (বর্তমানে নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর) বিশ্বজিৎ বড়ুয়া, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির সিনিয়র স্টাফ নার্স আহসান হাবিব, বরিশাল নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বর্তমানে নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর মো. সাইব হোসাইন রনি মোল্লা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসরাত জাহান এবং নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আনিসুর রহমান।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রশ্রয়ে তারা স্বেচ্ছাচারিতা, সাধারণ নার্সদের হয়রানি এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে উঠেছে।
তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে সাধারণ নার্সদের থেকে চাঁদাবাজি, সরকারি হাসপাতাল থেকে কমিশনের বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠানো, সরকারি চাকরিরত অবস্থায় নার্সিং কলেজ পরিচালনা, ছাত্রীনিবাসের কক্ষ দখল করে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস, স্থানীয়দের নিয়ে নার্সিং কলেজ শিক্ষার্থীদের মারধর এবং ওষুধ চুরি করতে গিয়ে পুলিশের কাছে আটক হওয়ার ঘটনা।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আনিসুর রহমান স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালে নার্স নিয়োগের প্রশ্নফাঁস কাণ্ডে তিনি অভিযুক্ত। চাঁদাবাজি ও বদলি-বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের অন্যতম মূলহোতা তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসক ও নার্সসহ বিভিন্নজনকে হুমকি ও হেনস্তা করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই তিনি সহকারী স্টাফ নার্স হিসেবে ঢামেকে নিয়োগ পান। কয়েক বছরের ব্যবধানে নিয়ম ভেঙে বিশেষ বিবেচনায় তিনি এবং আরও কয়েকজন সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে পদোন্নতি পান।
তিনি নিজেকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, জাহিদ মালেক, ডা. সামন্ত লাল সেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং স্বাচিপের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে দাপটে চলাফেরা করতেন।
তিনি বৈধ ইজারাদারকে উৎখাত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সেস কল্যাণ ক্যান্টিন দখল করেন। নার্সদের ভালো পদায়নের প্রলোভন দেখিয়ে আওয়ামী লীগের আমলে মাসোহারা নিতেন এবং অধিদপ্তরে দাপিয়ে বেড়াতেন।
ঢামেকে কর্মরত থাকলেও তিনি সারা দেশে নার্স নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য তদবির করে বিপুল অর্থ আয় করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে নার্সদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন এবং হাসপাতালের পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের সামনে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতেন।
গত ৫ আগস্টের পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বদলি করা হলেও অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাকে সেখানে না পাঠিয়ে নারায়ণগঞ্জে বদলি করেন। ঢাকার নিকটবর্তী থাকায় তিনি এখনো অধিদপ্তরে বদলি সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমি স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের সভাপতি ছিলাম, এটা সত্য। তবে আমার সঙ্গে অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা বা নার্স কিংবা ডাক্তার নেতার কোনো পরিচয় ছিল না। আমি কাউকে চিনতাম না। তাই আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সত্য নয়।’
জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সিনিয়র স্টাফ নার্স মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (জুয়েল) স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব। তিনিও ২০১৭ সালের প্রশ্নফাঁস কাণ্ডে অভিযুক্ত। নিটোর থেকে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠানোর সিন্ডিকেটের মূলহোতা।
তিনি ১৫ বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চাঁদাবাজি ও বদলি-বাণিজ্যে সক্রিয়। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম, জাহিদ মালেক, ডা. সামন্ত লাল সেন এবং স্বাচিপ সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান ও ডা. কামরুল ইসলাম মিলনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে সাধারণ নার্সদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এরপর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কোনো দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হইনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ হয়তো আমাকে হেয় করতে এসব অভিযোগ তুলেছে। তবে এসবের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের একজন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে পরপর দুবার সরকারি অর্থায়নে কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে নিয়মবহির্ভূতভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে নার্স বদলি ও পদায়ন বাণিজ্যের অন্যতম হোতা।
তিনি কর্মস্থলে না থেকে সারা দিন অধিদপ্তরে বসে থাকেন। গত পাঁচ বছর ধরে নিয়ানার ছাত্রীনিবাসের তিনটি কক্ষ দখল করে বসবাস করছেন। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলও দেন না। ছাত্রীদের একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও নিয়ানার পরিচালক তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, অভিযুক্তদের মধ্যে একজন স্বানাপের যুগ্ম মহাসচিব এবং বদলি-বাণিজ্য সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। একজন চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বর্তমানে নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর; স্বানাপের চট্টগ্রাম জেলার মহাসচিব। তিনি প্রগতি নার্সিং কলেজসহ একাধিক নার্সিং কলেজের মালিক।
আরেকজন ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চাকরিরত অবস্থায় এনজিও প্রো-নার্স প্রজেক্টে অনিয়ম করে চাকরি নেন এবং সরকারি চাকরিরত অবস্থায় টাঙ্গাইলে ‘সুপ্রিম নার্সিং কলেজ’ খুলে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
অন্যজন বরিশাল নার্সিং কলেজে স্থানীয়দের দিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধরের সঙ্গে জড়িত। আরেকজন স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি। তিনি সরকারি ওষুধ চুরির অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইসরাত জাহানের অপকর্মের বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, আট নার্সের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি। শিগগিরই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে মতামত দেওয়া হবে।
তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে আনোয়ার হোছাইন বলেন, আমার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।
সূত্র: কালবেলা
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ




